তিনদিনে তিস্তা নদীর পানি বেশ কমে গিয়ে চরে তলিয়ে যাওয়া ফসল বেরিয়ে এসেছিল। চব্বিশ ঘণ্টা পার হতে না হতেই উজানের ঢলে চরের কৃষকদের আরও সর্বনাশ ঘটেছে।
শুক্রবার (২৩ মে) নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার (৫২.১৫) দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে (৫১.৫৮) প্রবাহিত হচ্ছিল। এর ২৪ ঘণ্টা পূর্বে পানি প্রবাহ ছিল বিপৎসীমার ১০৩ সেন্টিমিটার নিচে। এতে ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে দশমিক ৪৬ সেন্টিমিটার। অপর দিকে রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে বিপৎসীমার (২৯.৩১) ৮২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে (২৮.৪৯) প্রবাহিত হচ্ছে। এই পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে এবং পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপ অপারেটর নুরুল ইসলাম ও কাউনিয়া পয়েন্টের পানি পরিমাপ অপারেটর আকতার আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কৃষকরা বলছেন টানা বৃষ্টিপাত ও উজানের পাহাড়ি ঢলে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রামের চরাঞ্চল ও সমতলে পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলের ফসলি জমি নতুন করে তলিয়ে গেছে। এতে ধান, বাদাম, কাউন, গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি, মরিচ, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল তলিয়ে যাওয়ায় তীর মুখে পড়েছেন কৃষকরা।
কাউনিয়ার পরিস্থিতি আরও খারাপ। তিস্তার জেগে ওঠা ১৫টি চরের বাদাম চাষিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তারা জানাচ্ছেন, পানি কমে গিয়েছিল, কিন্তু শুক্রবার আবারও বেড়ে গেছে। কাউনিয়ায় এমন কোনো চর নেই যেখানে বাদাম চাষ হয়নি। অধিকাংশ চরেই বাদাম তলিয়ে গেছে। চলতি মৌসুমে ৮৭৫ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষ হয়। ইউপি সদস্য শাহ আলম জানান, তার ওয়ার্ডের গদাই, পাঞ্চরভাঙ্গা ও চরঢুসমারা গ্রামের অধিকাংশ চরের বাদাম হঠাৎ নদীর পানি বৃদ্ধিতে তলিয়ে গেছে।
টেপামধুপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম জানান, ইউনিয়নটি তিস্তা নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় প্রতিবছরই নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়। নদীতে নতুন চর জেগে ওঠায় সেখানে ব্যাপক হারে বাদাম চাষ হচ্ছে। হঠাৎ নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরাঞ্চলের অনেক জমি পানিতে তলিয়ে শতশত কৃষক তীর মুখে পড়েছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে রংপুর অঞ্চলের সমতল ও তিস্তার চরাঞ্চল মিলে একশ হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার মধ্যে গ্রীষ্মকালীন সবজি ও বাদামের পরিমাণ বেশি। শুক্রবার তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেলে ফসলি জমি পুনরায় তলিয়ে গিয়ে এর পরিধি বেড়েছে। গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, হাতীবান্ধা, আলমবিদিতর, মিঠাপুকুর, পীরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্রীষ্মকালীন শাকসবজিসহ ধান, বাদাম, কাউন, মরিচ ও ভুট্টা প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবে গেছে। কষ্টে বোনা ফসল বাঁচাতে শেষ চেষ্টা চালাচ্ছেন কৃষকরা।
তিস্তার চরগুলোতে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে বাদাম। চর মহিপুর, পূর্ব ইচলি, চর ইচলি, চর ইশোরকুল, শংকরদহ, ছালাপাক, আলফাজটারী, শেখপাড়া, চিলাখালসহ প্রায় সব চরেই তলিয়ে যাওয়া বাদাম তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। চর শংকরদহের বাসিন্দা মকবুল হোসেন বলেন, জমিজমা তো সব তিস্তা খেয়ে নিয়েছে। ধারদেনা করে মানুষের দুই বিঘা জমি লিজ নিয়ে বাদাম আর কাউন চাষ করছিলাম। কাউন তো আর হবে না, বাদামগুলো রাই শেষ চেষ্টা করছি।
চরাঞ্চলের পাশাপাশি সমতলের নিচু এলাকাগুলোতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। মিঠাপুকুর ও সদর উপজেলা সহ বেশ কিছু এলাকার ৫০ হেক্টর জমির ফসল ডুবে গেছে। কৃষকরা বলছেন, বৃষ্টির পানিতে করলা, ঝিঙেসহ প্রায় সব ধরনের ফসলই তলিয়ে গেছে। তলিয়ে যাওয়া ৭০ শতাংশ ফসলই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। রানীপুকুরের পূর্বপাড়া এলাকার রহিম উদ্দিন বলেন, অনেক কষ্ট করে জমি বন্ধক নিয়ে এবং ঋণ করে আবাদ করেছি, কয়েক দিনের বৃষ্টির পানিতে সব আশা শেষ।
সাইফুল ইসলাম নামে এক কৃষক বলেন, এমনিতেই চরাঞ্চলে এক মৌসুমের আবাদ হয়, সেটাও এবার আর হলো না। বাদাম চাষ করেছিলাম, কিন্তু সব পানিতে ডুবে গেছে।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ফসল পানিতে নিমজ্জিত হওয়া মানে নষ্ট হয়ে যাওয়া নয়। যদি পানি এক সপ্তাহের মধ্যে সরে যায়, তাহলে জমির ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না। তাছাড়া জমির পানি যদি পরিষ্কার হয়, তাহলে তেমন চিন্তার কিছু নেই। তবে যদি পানি কাদা মিশ্রিত হয়, তাহলে দ্রুত সার দিয়ে ফসল সারিয়ে তুলতে হবে এবং পানি স্প্রে করে কাদা ধুয়ে ফেলতে হবে জমি থেকে।