০৮:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫

বাসা তৈরির সময় ট্রি ট্রি ট্রি প্রিট প্রিট, ব্রিট ব্রিট ধ্বনি তোলে

ট্রি-ট্রি-ট্রি, প্রিট প্রিট বা ব্রিট ব্রিট এমন করে ধ্বনি তোলে। অবাক হওয়ারই কথা এ কেমন হাঁকডাক। এমন শব্দ কোনো প্রাণীর হতে পারে- এমন প্রশ্ন এসেই যায়। এটি একটি বিস্ময়কর এক পাখির ডাক। ছোট্ট সুন্দর পাখিটি খানিকটা লাজুক প্রকৃতির। আকারে বোধহয় চড়–ই পাখির সমানই হতে পারে। এই পাখির নাম মুনিয়া। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামে গ্রামে এই পাখির অবাধ বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়।

মুনিয়ারা সাধারণত দল বেঁধে, কখনো বা জোড়া বেঁধে চলে। নদীর ধারে কাশবনে, ফসলের খেতে, খোলা মাঠের ঘাসবনে মুনিয়াদের দেখা মেলে। মাটিতে হাঁটতে কষ্ট হয় মুনিয়াদের। তাই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায় গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে রাত কাটায়। অনেক প্রজাতির মুনিয়া আছে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত পাঁচ প্রজাতির মুনিয়ার সাক্ষাৎ মেলে। এর মধ্যে ধলাকোমর মুনিয়া, লাল মুনিয়া, কালো মাথার মুনিয়া বেশি দেখা যায়। তবে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী বিভিন্ন এলাকায় কালো মাথার মুনিয়ার বিচরণ সব থেকে বেশি।

এবার চোখে পড়েছে এই পাখিটি শরতের কাশবন ও ছোট গাছে বাবুই পাখির মতো শৈল্পিক নৈপুণ্যে নান্দনিক বাসা তৈরি করেছে। নীলফামারীর চরাঞ্চল, চাড়ালকাটা নদী, ধাইজান নদীসহ কয়েকটি নদীতে ও পাশের জলাধারে কাশবন এবং অসংখ্য ছোট গাছে স্বপ্নের নীড় বুনছে কালো মাথার মুনিয়া। সকালে ও সন্ধ্যায় এদের গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। পাখিপ্রেমিক লোকজন তাদের আগলে রাখেন। ধাইজান নদীর কাছেই মাঝারি গোছের একটি কাশবন ও একটি ছোট ইউক্যালিপটাস গাছে দেখা মিলেছে কালো মাথার মুনিয়ার অসংখ্য বাসা।

ক্ষণস্থায়ী বাসার ওপরেই ব্রিট-ব্রিট, প্রিট-প্রিট-ট্রি-ট্রি-ট্রি এমন ধ্বনি দিয়ে ডাক দিয়ে তারা আনন্দ উপভোগ করছে। কিশোরগঞ্জ উপজেলার নদীবেষ্টিত জলাধার, নদীর দুই পাড়ের কাশবন, ছোট গাছে মুনিয়া পাখির অসংখ্য বাসা ও তাদের ঝাঁকে ঝাঁকে চলাফেরা করতে দেখা গেছে।

মুনিয়া পাখিরা মাঝারি ঝোপ, বনের ভেতরের পরিষ্কার জায়গা, তৃণভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোপে বিচরণ করে। এরা দলবেঁধে চলতে পছন্দ করে। সচরাচর প্রতিটি ঝাঁকে ১০ থেকে ১৫টি পাখি থাকে। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাসের মধ্যে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের প্রধান খাবার হচ্ছে শস্যবীজ। তবে ঘাসবীজ, বাঁশবীজ, বিভিন্ন শাক, লতাপাতা, পোকামাকড়ও খায় এরা। কাশফুল ওদের বাসার আবশ্যিক অনুষঙ্গ।

বাসা করে গোলগাল ধরনের ছোট বা মাঝারি ফুটবল আকারের প্রবেশ দরজা খুঁজে পাওয়া দুরূহ কাজ। উপকরণ থাকে ছোট ছোট বাঁশপাতা, কাশফুলগাছের শিকড়, পাটের আঁশ, শুকনা ঘাস, কুটা, ধানপাতা, কচুরিপানার শিকড়সহ অনেক কিছু। বাসার ভেতরে ওরা শুধু কাশফুল দিয়ে মখমলের মতো গদি বানায়। ওখানে কিছুটা লম্বাটে (করমচা ফলের মতো) আকারের চকচকে ডিম পাড়ে ৫ থেকে ৮টি। ডিমগুলোকে মনে হয় মুক্তাদানা। দুজনে পালা করে ১২ থেকে ১৬ দিন ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে ছানা হয়। ছানারা উড়তে শেখে ১৬ থেকে ২১ দিন পর।

বাসা ছেড়ে ছানারা বাইরে এসে যখন গাছের শাখায় শরীরে শরীর মিশিয়ে পাশাপাশি সারিতে বসে থাকে, তখন দেখতে লাগে দারুণ সুন্দর। অবশ্য মা-বাবা পাখি বাসা বাঁধার জায়গা পছন্দে ব্যয় করে ৪ থেকে ৮ দিন। বাসা বানানোর সময় মুনিয়ারা মিহি সুরে আনন্দসংগীত চালিয়ে যায়। এমনিতেই গলাটা এদের মিনমিনে, সুরেলা-বিষণ যেন বা কান্না মেশানো থাকে ডাক ও গানে। অতি নিরীহ নির্ভেজাল পাখি।

ডিম-ছানার অনেক শত্রু আছে এদের। গেছোসাপ, দাঁড়াশ সাপ, গুইসাপ এদের ডিম-ছানা গেলে। সুযোগ পেলে কাঠবিড়ালিরা অকারণে এদের বাসা তছনছ-ল-ভ- করে (কাঠবিড়ালির বাসার সঙ্গে এদের বাসার গড়ন ও উপকরণের অনেক মিল আছে)। তাই মুনিয়া পাখি এই শত্রুদের হাত থেকে ছানা বাঁচাতে কাশবনের সরু ডালে বাসা তৈরি করছে বলে অনুমান করছেন মানুষ।

কাশবন-ঘাসবন, ঝোপঝাড় বা খোলা মাঠে ছানাপোনাসহ খাবারের সন্ধানের সময় এই পাখিরা নিচে নামে। তখন ওত পেতে থাকা সোনাব্যাঙদের শিকার হয়। লাফ দিয়ে সোনাব্যাঙ গপাত করে মুখে পুরে নেয় ছোট্ট পাখিদের। সোনাব্যাঙ এদের জন্য বিভীষিকা!

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী উদ্ধার ও নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ এই পাখি দেখে বলেন, দুর্লভ পাখি কালো মাথার মুনিয়া। ছোট্ট সুন্দর পাখিটি খানিকটা লাজুক প্রকৃতির। আকারে চড়ই পাখির সমান। মুনিয়া বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে। মুনিয়ারা সাধারণত দলবেঁধে, কখনো বা জোড়া বেঁধে চলে। নদীর ধারে কাশবনে, ফসলের খেতে, খোলা মাঠের ঘাসবনে মুনিয়াদের দেখা মেলে। মাটিতে হাঁটতে কষ্ট হয় মুনিয়াদের। তাই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে।

পাখিপ্রেমিক অজয় দাস বলেন, মুনিয়ারা গাছে যেসব বাসা বাঁধে ওগুলো রেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করে। ঝোপঝাড় কিংবা কাশবনে বাসাগুলোতে স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে, ছানা ফুটায়। পুরুষ পাখিরা বাসা বানায়। নির্জন জায়গায় বাসা বাঁধতে এরা পছন্দ করে। লোকালয়ের কাছে মুনিয়াদের বাসা বাঁধার বিষয়টিতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এরা সাধারণত লোকালয়ে থাকে না। তিনি বলেন, শুকনা খড় লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। নতুন সংসারে পাঁচ থেকে ছয়টি ডিম দেয়।

ডিমের রং ধবধবে সাদা হয়। ১২ থেকে ১৬ দিনে ডিম ফুটে ছানা বেরিয়ে আসে। মা-বাবা পালাক্রমে ছানাদের খাদ্যের জোগান আর পাহারা দেয়। মা মুনিয়া ছানাদের ছয় থেকে সাত দিন বুকে আগলে রাখে। ১৫ থেকে ১৯ দিন বয়সের মাথায় মা-বাবার পাশাপাশি ছানা মুনিয়ারাও উড়ে বেড়ায়। কালো মাথার মুনিয়া আকারে একটি ছোট পাখি। এর মাথা, ঘাড়, গলা ও বুকের কিছু অংশ কালো হয়। ডানা ও পিঠ লালচে বাদামি রঙের। মুনিয়ার ঠোঁট শক্ত, ত্রিকোনাকার এবং হাল্কা নীলচে।

প্রাকৃতিক পরিবেশে মুনিয়ারা সাত থেকে আট বছর বেঁচে থাকে। তবে খাঁচায় বন্দি করলে এদের গড় আয়ু বড়োজোর চার বছর হয়। ওই এলাকার চল্লিশ বছর বয়সি কৃষক চাঁদ মিয়া বলেন, এর আগে কখনোই এমন পাখি দেখি নাই। প্রথম চোখে পড়ছে এই ছোট পাখিদের। কখনো নদীতে, কখনো পুকুরে এদের দলবদ্ধভাবে গোসল করতে দেখি। তাদের গোসলের দৃশ্য খুবই ভালো লাগে। কারণ আমাদের এলাকায় পাখি তেমন চোখে পড়ে না। ওই পাখিগুলোর বাসা আমাদের খুব আকৃষ্ট করে। তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেল গাছ ও উঁচু গাছগুলোতে বাবুই পাখির বাসা দেখেছি। এত ছোট গাছে ও কাশবনে এমন বাসা দেখিনি কখনো। পাখি ও তাদের বাসা দেখে মনের আনন্দ জোগায়।

শিক্ষক গোলাম আজম বলেন, দুর্লভ পাখিগুলোর রক্ষায় আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাখিগুলোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে এলাকাকে জীববৈচিত্র্যময় গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃতিতে তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকে এমন উদ্যোগ নিতে হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

নীলফামারীতে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ইউনিটের কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাচন-২০২৫ অনুষ্ঠিত

বাসা তৈরির সময় ট্রি ট্রি ট্রি প্রিট প্রিট, ব্রিট ব্রিট ধ্বনি তোলে

প্রকাশিত ০৬:০১:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ অক্টোবর ২০২৫

ট্রি-ট্রি-ট্রি, প্রিট প্রিট বা ব্রিট ব্রিট এমন করে ধ্বনি তোলে। অবাক হওয়ারই কথা এ কেমন হাঁকডাক। এমন শব্দ কোনো প্রাণীর হতে পারে- এমন প্রশ্ন এসেই যায়। এটি একটি বিস্ময়কর এক পাখির ডাক। ছোট্ট সুন্দর পাখিটি খানিকটা লাজুক প্রকৃতির। আকারে বোধহয় চড়–ই পাখির সমানই হতে পারে। এই পাখির নাম মুনিয়া। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের গ্রামে গ্রামে এই পাখির অবাধ বিচরণ দেখতে পাওয়া যায়।

মুনিয়ারা সাধারণত দল বেঁধে, কখনো বা জোড়া বেঁধে চলে। নদীর ধারে কাশবনে, ফসলের খেতে, খোলা মাঠের ঘাসবনে মুনিয়াদের দেখা মেলে। মাটিতে হাঁটতে কষ্ট হয় মুনিয়াদের। তাই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। গাছের ডালে বসে জোড়ায় জোড়ায় গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে রাত কাটায়। অনেক প্রজাতির মুনিয়া আছে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত পাঁচ প্রজাতির মুনিয়ার সাক্ষাৎ মেলে। এর মধ্যে ধলাকোমর মুনিয়া, লাল মুনিয়া, কালো মাথার মুনিয়া বেশি দেখা যায়। তবে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী বিভিন্ন এলাকায় কালো মাথার মুনিয়ার বিচরণ সব থেকে বেশি।

এবার চোখে পড়েছে এই পাখিটি শরতের কাশবন ও ছোট গাছে বাবুই পাখির মতো শৈল্পিক নৈপুণ্যে নান্দনিক বাসা তৈরি করেছে। নীলফামারীর চরাঞ্চল, চাড়ালকাটা নদী, ধাইজান নদীসহ কয়েকটি নদীতে ও পাশের জলাধারে কাশবন এবং অসংখ্য ছোট গাছে স্বপ্নের নীড় বুনছে কালো মাথার মুনিয়া। সকালে ও সন্ধ্যায় এদের গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। পাখিপ্রেমিক লোকজন তাদের আগলে রাখেন। ধাইজান নদীর কাছেই মাঝারি গোছের একটি কাশবন ও একটি ছোট ইউক্যালিপটাস গাছে দেখা মিলেছে কালো মাথার মুনিয়ার অসংখ্য বাসা।

ক্ষণস্থায়ী বাসার ওপরেই ব্রিট-ব্রিট, প্রিট-প্রিট-ট্রি-ট্রি-ট্রি এমন ধ্বনি দিয়ে ডাক দিয়ে তারা আনন্দ উপভোগ করছে। কিশোরগঞ্জ উপজেলার নদীবেষ্টিত জলাধার, নদীর দুই পাড়ের কাশবন, ছোট গাছে মুনিয়া পাখির অসংখ্য বাসা ও তাদের ঝাঁকে ঝাঁকে চলাফেরা করতে দেখা গেছে।

মুনিয়া পাখিরা মাঝারি ঝোপ, বনের ভেতরের পরিষ্কার জায়গা, তৃণভূমি ও ক্ষুদ্র ঝোপে বিচরণ করে। এরা দলবেঁধে চলতে পছন্দ করে। সচরাচর প্রতিটি ঝাঁকে ১০ থেকে ১৫টি পাখি থাকে। মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘাসের মধ্যে এরা খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের প্রধান খাবার হচ্ছে শস্যবীজ। তবে ঘাসবীজ, বাঁশবীজ, বিভিন্ন শাক, লতাপাতা, পোকামাকড়ও খায় এরা। কাশফুল ওদের বাসার আবশ্যিক অনুষঙ্গ।

বাসা করে গোলগাল ধরনের ছোট বা মাঝারি ফুটবল আকারের প্রবেশ দরজা খুঁজে পাওয়া দুরূহ কাজ। উপকরণ থাকে ছোট ছোট বাঁশপাতা, কাশফুলগাছের শিকড়, পাটের আঁশ, শুকনা ঘাস, কুটা, ধানপাতা, কচুরিপানার শিকড়সহ অনেক কিছু। বাসার ভেতরে ওরা শুধু কাশফুল দিয়ে মখমলের মতো গদি বানায়। ওখানে কিছুটা লম্বাটে (করমচা ফলের মতো) আকারের চকচকে ডিম পাড়ে ৫ থেকে ৮টি। ডিমগুলোকে মনে হয় মুক্তাদানা। দুজনে পালা করে ১২ থেকে ১৬ দিন ডিমে তা দেওয়ার পর ডিম ফুটে ছানা হয়। ছানারা উড়তে শেখে ১৬ থেকে ২১ দিন পর।

বাসা ছেড়ে ছানারা বাইরে এসে যখন গাছের শাখায় শরীরে শরীর মিশিয়ে পাশাপাশি সারিতে বসে থাকে, তখন দেখতে লাগে দারুণ সুন্দর। অবশ্য মা-বাবা পাখি বাসা বাঁধার জায়গা পছন্দে ব্যয় করে ৪ থেকে ৮ দিন। বাসা বানানোর সময় মুনিয়ারা মিহি সুরে আনন্দসংগীত চালিয়ে যায়। এমনিতেই গলাটা এদের মিনমিনে, সুরেলা-বিষণ যেন বা কান্না মেশানো থাকে ডাক ও গানে। অতি নিরীহ নির্ভেজাল পাখি।

ডিম-ছানার অনেক শত্রু আছে এদের। গেছোসাপ, দাঁড়াশ সাপ, গুইসাপ এদের ডিম-ছানা গেলে। সুযোগ পেলে কাঠবিড়ালিরা অকারণে এদের বাসা তছনছ-ল-ভ- করে (কাঠবিড়ালির বাসার সঙ্গে এদের বাসার গড়ন ও উপকরণের অনেক মিল আছে)। তাই মুনিয়া পাখি এই শত্রুদের হাত থেকে ছানা বাঁচাতে কাশবনের সরু ডালে বাসা তৈরি করছে বলে অনুমান করছেন মানুষ।

কাশবন-ঘাসবন, ঝোপঝাড় বা খোলা মাঠে ছানাপোনাসহ খাবারের সন্ধানের সময় এই পাখিরা নিচে নামে। তখন ওত পেতে থাকা সোনাব্যাঙদের শিকার হয়। লাফ দিয়ে সোনাব্যাঙ গপাত করে মুখে পুরে নেয় ছোট্ট পাখিদের। সোনাব্যাঙ এদের জন্য বিভীষিকা!

রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী উদ্ধার ও নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ এই পাখি দেখে বলেন, দুর্লভ পাখি কালো মাথার মুনিয়া। ছোট্ট সুন্দর পাখিটি খানিকটা লাজুক প্রকৃতির। আকারে চড়ই পাখির সমান। মুনিয়া বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে। মুনিয়ারা সাধারণত দলবেঁধে, কখনো বা জোড়া বেঁধে চলে। নদীর ধারে কাশবনে, ফসলের খেতে, খোলা মাঠের ঘাসবনে মুনিয়াদের দেখা মেলে। মাটিতে হাঁটতে কষ্ট হয় মুনিয়াদের। তাই তারা লাফিয়ে লাফিয়ে চলে।

পাখিপ্রেমিক অজয় দাস বলেন, মুনিয়ারা গাছে যেসব বাসা বাঁধে ওগুলো রেস্টরুম হিসেবে ব্যবহার করে। ঝোপঝাড় কিংবা কাশবনে বাসাগুলোতে স্ত্রী পাখি ডিম পাড়ে, ছানা ফুটায়। পুরুষ পাখিরা বাসা বানায়। নির্জন জায়গায় বাসা বাঁধতে এরা পছন্দ করে। লোকালয়ের কাছে মুনিয়াদের বাসা বাঁধার বিষয়টিতে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। এরা সাধারণত লোকালয়ে থাকে না। তিনি বলেন, শুকনা খড় লতাপাতা বাসা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। নতুন সংসারে পাঁচ থেকে ছয়টি ডিম দেয়।

ডিমের রং ধবধবে সাদা হয়। ১২ থেকে ১৬ দিনে ডিম ফুটে ছানা বেরিয়ে আসে। মা-বাবা পালাক্রমে ছানাদের খাদ্যের জোগান আর পাহারা দেয়। মা মুনিয়া ছানাদের ছয় থেকে সাত দিন বুকে আগলে রাখে। ১৫ থেকে ১৯ দিন বয়সের মাথায় মা-বাবার পাশাপাশি ছানা মুনিয়ারাও উড়ে বেড়ায়। কালো মাথার মুনিয়া আকারে একটি ছোট পাখি। এর মাথা, ঘাড়, গলা ও বুকের কিছু অংশ কালো হয়। ডানা ও পিঠ লালচে বাদামি রঙের। মুনিয়ার ঠোঁট শক্ত, ত্রিকোনাকার এবং হাল্কা নীলচে।

প্রাকৃতিক পরিবেশে মুনিয়ারা সাত থেকে আট বছর বেঁচে থাকে। তবে খাঁচায় বন্দি করলে এদের গড় আয়ু বড়োজোর চার বছর হয়। ওই এলাকার চল্লিশ বছর বয়সি কৃষক চাঁদ মিয়া বলেন, এর আগে কখনোই এমন পাখি দেখি নাই। প্রথম চোখে পড়ছে এই ছোট পাখিদের। কখনো নদীতে, কখনো পুকুরে এদের দলবদ্ধভাবে গোসল করতে দেখি। তাদের গোসলের দৃশ্য খুবই ভালো লাগে। কারণ আমাদের এলাকায় পাখি তেমন চোখে পড়ে না। ওই পাখিগুলোর বাসা আমাদের খুব আকৃষ্ট করে। তালগাছ, খেজুরগাছ, নারিকেল গাছ ও উঁচু গাছগুলোতে বাবুই পাখির বাসা দেখেছি। এত ছোট গাছে ও কাশবনে এমন বাসা দেখিনি কখনো। পাখি ও তাদের বাসা দেখে মনের আনন্দ জোগায়।

শিক্ষক গোলাম আজম বলেন, দুর্লভ পাখিগুলোর রক্ষায় আমাদের সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। পাখিগুলোর অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে এলাকাকে জীববৈচিত্র্যময় গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃতিতে তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকে এমন উদ্যোগ নিতে হবে।