কিছু কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য, শিক্ষকদের পাঠদানে উদাসিনতা, সঠিক তদারকির অভাব, দিনের পর দিন নৈমিত্তিক ছুটির কালচার, বিদ্যালয়ে অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশ, শিক্ষকদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগের অভাব ও সমন্বয়হীনতা, অভিভাবকদের সাথে শিক্ষকদের যোগাযোগ না থাকাসহ বিভিন্ন কারনে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দিন দিন কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
এসব কারনে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় সরকারী প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা বেহাল হয়ে পড়েছে। সময় থাকতে উপরোক্ত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ব্যাবস্থা গ্রহন না করলে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যাবস্থায় মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে ধারনা করছে এলাকার শিক্ষিত সুধি সমাজ ও অভিভাবকগন।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংখ্যা ১৭৫ টি। এত সংখ্যাক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক কর্মরত রয়েছে প্রায় একহাজার। পদ শুন্য রয়েছে ৫ জনের। ১৭৫ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৭৫ জন প্রধান শিক্ষক কর্মরত থাকার কথা থাকলে কর্মরত রয়েছে মাত্র ৭২ জন। ১০৩ জন প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য রয়েছে। অবসর ও মৃত্যুজনিত কারনে ১০৩ জনের শুন্য পদে ৪৩ জনকে পদায়ন করে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হলেও এখোনো ৬০ জন প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য। এদিকে একটি সুত্র জানিয়েছে এ উপজেলার ১৭৫ টি বিদ্যালয়ে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী থাকার কথা। কিন্তু গত বছরে ১৭৫ টি বিদ্যালয়ে ২১৩৩৪ জন শিক্ষার্থী ভর্তি ছিল। এ বছর মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ড, মোসা,মাহমুদা খাতুন।
গত বৃহস্পতিবার ও রবিবার এলাকাবাসীর অভিযোগ ও সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দুরে মাগুড়া ইউনিয়নের মাগুড়া ফকির পাড়া গ্রামে দৃষ্টিনন্দন একটি দ্বিতল ভবন। ভবনটি কাছে গিয়ে দেখা যায়, এটি মাগুড়া পীর ফকিরপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভবনটির কাছে না গিয়ে বোঝার উপায় নেই এটি স্কুল নাকি অন্য কিছু। কারন ভবনটির সামনে সুনসান নিরবতা কোথাও কোন কোলাহল নেই। এসময় স্কুলের ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায়, একজন সহকারী শিক্ষিকা পঞ্চম শ্রেনীর ক্লাস নিচ্ছে ক্লাসে মোট ৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। অপর একটি কক্ষে আরও একজন সহকারী শিক্ষক ক্লাস নিচ্ছেন সেখানেও উপস্থিত মাত্র চারজন শিক্ষার্থী। এসময় চতুর্থ শ্রেনীতে কোন শিক্ষার্থী উপস্থিত নেই কেন জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক মাবিয়া বেগম বলেন, চতুর্থ শ্রেনীর শিক্ষার্থীরা একটু বাইরে গেছে, ক্লাস রেখে বাইরে কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমি তাঁদেরকে ডাকছি আসলেই ক্লাস শুরু করা হবে। শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম কেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, অনেক শিক্ষার্থীর জ¦র তাই তারা আসতে পারেনি।
পুষনা শহীদ শরিফুল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র, বিদ্যালয় মাঠের দক্ষিন দিকে একটি বিরাট গর্ত করে রাখা হয়েছে। শিশু শিক্ষার্থীরা যে কোন মুহুত্বে ওই গর্তে পরে গিয়ে মুহুর্তেই যে ধরনের বিপদ ঘটে যেতে পারে। এছাড়াও বিদ্যালয়টির মেইন গেটের সামনে হাঁটু পরিমান কাঁদাপানি এবং স্কুলটির চারদিকে ঘিরে আছে বড় বড় ডোবা। ডোবার পানিগুলো দুগন্ধযুক্ত, পানিগুলোতে মশা মাছিসহ বিভিন্ন ময়লা আর্বজনায় ভরপুর এককথায় নোংরা পরিবেশ। এর পরে বিদ্যালয়টিতে প্রবেশ করে দেখা যায় দুইজন সহকারী শিক্ষিকা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন। একটি ক্লাসে চারজন ও অন্য একটি ক্লাসে ৬ জন।
এসময় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মকছুদার রহমান জানান, এই বিদ্যালয়টি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্টা পেয়েছে। বিদ্যালয়টিতে আগে ১১০ জন শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু বর্তমানে কাগজে কলমে ৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। মোট শিক্ষকের পদ ৬ টি। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকের পদটি শুন্য। ৫ জন শিক্ষকের মধ্যে ৪ জন উপস্থিত থাকলেও অপর শিক্ষক ছটিতে ছিলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক বলেন, বিদ্যালয়টিতে প্রতিদিন গড়ে দুই শিফটে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। এখানে কোন পড়াশুনা হয়না তাই শিক্ষার্থী আসেনা।
গত ১১ আগষ্ট রবিবার মন্থনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীতে মোট ৩ জন শিক্ষার্থী, চতুর্থ শ্রেনীতে চার জন ও তৃর্তীয় শ্রেনীতে ৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। জানা গেছে, ওই বিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের পদ ৬ টি। এর মধ্যে কর্মরত ৫ জন। উপস্থিত ছিলেন ৩ জন শিক্ষক। বাকি দুই জন শিক্ষকের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা জেসমিন আক্তার ও মিজানুর রহমান নৈমিত্তিক ছুটিতে রয়েছে। এসময় হাজিরা খাতা ঘেঁটে দেখা যায়, মিজানুর রহমান নামের সহকারী শিক্ষক গত জুলাই মাসে একটানা ৬ দিন এবং আগষ্ট মাসে একটানা ১ তারিখ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত বিদ্যালয়ে অনপুস্থিত। এছাড়াও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জেসমিন খাতুনও নৈমিত্তিক ছুটি নিয়ে অনপুস্তিত।
এদিকে পুটিমারী ইউনিয়নের ঘোনপাড়া মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে একই চিত্র দেখা দেখা গেছে। ঘোনপাড়া মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের বাড়ি ও স্কুলের দুরত্ব কাছাকাছি হওয়ায় কারনে প্রদান শিক্ষক বিদ্যালয়ের বারান্দা ও রুমগুলোর ভিতরে নিজের সাংসারিক জিনিসপত্র রাখার কাজে ব্যাবহার করেন বলে অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। ফলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা করতে সমস্যা হয়। এ কারনেও বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমছে বলে জানান এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঘোনপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বিদ্যালয়ের ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থী জ¦রে আক্লান্ত তাই তারা আসতে পারেনী। স্কুল মাঠে ও বারান্দায় সাংসারিক উপকরন রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমার ভুল হয়েছে আগামীতে আর এরকম হবেনা।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ড. মোসা. মাহমুদা খাতুনের সাথে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থা ও বিদ্যালয়সমুহে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে। তিনি প্রাথমিকে শিক্ষার্থীদের অনুপুস্থিতির কথা অকপটে স্বীকার করে বলেন, যদি শিক্ষকরা সচেতন না হয় তাহলে কখনই প্রাথমিকের মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রাথমিকে প্রধান শিক্ষকের পদশুন্য মিডডে মিল বন্ধ এবং অলস শিক্ষক এর জন্য দায়ী। আমি জেনেছি অনেক শিক্ষক ঠিকমতো স্কুলে আসেনা। আর একটু কিছু হলেই নৈমিত্তিক ছুটি। আমি খুব দ্রুত বিষয়গুলোর খোঁজ খবর নিব।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রীতম সাহার সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে আইননুযায়ী ব্যাবস্থা গ্রহন করব। তবে তিনি জানান, আজ বুধবার আমি প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করলাম। মিটিংয়ে তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে কোন শিক্ষক বিদ্যালয়ে অনুপুস্থিত না থাকে। সহকারী শিক্ষা অফিসাররা যেন সঠিকভাবে প্রতিটি বিদ্যালয় মনিটরিং করে। প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ও শিক্ষার্থীদের শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন বলে এ প্রতিবেদকে জানান।
নীলফামারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কুমারেশ চন্দ্র গাছির সাথে কথা বললে তিনি বলেন, আমি উত্থাপিত অভিযোগ ইতিমধ্যে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি। সেই সাথে তিনি নিজেই বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন করে ব্যাবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানান। নৈমিত্তিক ছুটিকে ব্যাবহার কেউ যদি ইচ্ছাকৃত ছুটির নামে বাড়িতে বসে থেকে স্কুল ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে সেটি প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে। এখন থেকে কেউ ছুটি নিলে ছুটির কারন নিদিষ্ট করে জানাতে হবে। এক কথায় বিদ্যালয় গুলোতে কিভাবে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
























