উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা প্রবল বর্ষণের ফলে তিস্তা নদীর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ রক্ষায় নির্মিত ফ্লাড বাইপাস সড়কের ওপর দিয়েও প্রবল বেগে পানি প্রবাহিত হয়। বর্তমানে নদীর পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও নিম্নাঞ্চলে পানিবন্দি পরিস্থিতির আশঙ্কা রয়ে গেছে।
ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বিপৎসীমা অতিক্রম করে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত পানি প্রবাহকে স্বাভাবিক ধরা হয়। কিন্তু গত ৫ অক্টোবর সকাল ৯টায় পানি প্রবাহ ছিল ৫১ দশমিক ৪৮ সেন্টিমিটার, যা দুপুরে বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ দশমিক ৬ সেন্টিমিটারে। রাতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৫২ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটারে পৌঁছায়।
রবিবার রাত দুইটার দিকে পানি কমতে শুরু করে। সকাল ৭টায় ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং দুপুর ১২টায় তা বেড়ে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে (৫২ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার) প্রবাহিত হয়। এদিকে নদীর পানি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইসগেট খুলে রাখা হয়েছে।
পাহাড়ি ঢল আর উজানের পানি নামায় নীলফামারীর তিস্তা তীরবর্তী গ্রাম কালীগঞ্জ, ঝাড়সিংহেরশ্বর, খোগারচর, কিছামত ছাতনাই, উত্তর খড়িবাড়ী, চরখড়িবাড়ী, দক্ষিণ খড়িবাড়ী, পূর্ব খড়িবাড়ী, গয়াবাড়ী, ছোটখাতা, বাইশপুকুর, পারকিছামত, ফরেস্টের চর, কেল্লাপাড়া, ছাতুনাম এবং জলঢাকা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ও শোলমারী এলাকায় দেখা দিয়েছে নতুন করে বন্যা। ফ্লাড বাইপাসের ওপর দিয়ে তিস্তার পানি প্রবাহিত হচ্ছে, যা স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। নদী তীরের মানুষ এখন গৃহহারা হওয়ার শঙ্কায় রাত কাটাচ্ছেন।
সমতলের সব বসতবাড়িতেই কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর সমান পানি। ঘরের আসবাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, এমনকি গরু-ছাগলও এখন নদীরক্ষা বাঁধের ওপর আশ্রিত। অনেকে রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে, কেউবা প্লাস্টিক ও বাঁশের অস্থায়ী তাঁবু টানিয়ে কোনোভাবে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি নামার কোনো লক্ষণ নেই, বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিস্তায় স্রোত বেড়ে যাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা এই বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে ফসলের পাশাপাশি বসতভিটাও হারিয়ে যেতে পারে।
ডিমলা উপজেলার কিছামত ছাতনাই এলাকার কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, রোপা আমন ধান পুরোটাই ডুবে গেছে। বাড়ির মধ্যে এখন কোমর পানি, কিছুই বাঁচাতে পারি নাই। গরু-ছাগল নিয়া নদীর বাঁধে আশ্রয় নিলাম। উপজেলার গয়াবাড়ী গ্রামের অলিয়ার রহমান বলেন, কাজকাম বন্ধ। বাড়ির ভিতরে হাঁটুপানি। এখন কেমনে চলমু বুঝি না। সরকার যদি কিছু ত্রাণ দেয় তাইলে দুইটা দিন চলা যাবে। আর ত্রাণন দিয়াইবা কি হইব, আমাগো তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়া বেশি দরকার।
একই গ্রামের ফাতেমা খাতুন বলেন, এমন পানি আগে দেখিনি। প্রতিবারই ভাঙনে জমি যায়। এবার মনে হয় ঘরটাও থাকবে না। নদী একদম পাড়ে আইছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি কমার সম্ভাবনা আছে। তবে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় এমন পরিস্থিতি। দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বন্যা। নদীপাড়ের একাধিক স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও বাঁধের অংশ ভেঙে নদীর পানি সরাসরি গ্রামে ঢুকছে। ভাঙন ঠেকাতে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও ব্যাগ ফেলানো শুরু হয়েছে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তা অমিতাভ চৌধুরী বলেন, ভাঙন রোধে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোতে জিও ব্যাগ ফেলানো হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে পরামর্শ করে ইতোমধ্যে দুই হাজারের অধিক ব্যাগ ফেলা হয়েছে।
উপজেলা প্রশাসন বলছে, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরানুজ্জামান জানান, বন্যা মোকাবিলায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। পানিবন্দি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
























