সরকারী প্রকল্পসমুহের বিল উত্তোলনের ক্ষেত্রে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অফিসের শতকরা ১০ ভাগ অর্থ কমিশন প্রদানের অনিয়ম এখনও বহাল রয়েছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র হেরফের হয়নি।
বরং আগের চেয়েও বেশি মাত্রায় কমিশন আদায়ের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এমনই নজির পাওয়া গেছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে। চলতি ২০২৫-২০২৬ অর্থ বছরের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পসমুহের প্রথম পর্যায়ের বিল প্রদানের ক্ষেত্রে কমিশনের অর্থ কর্তনের ঘটনা ঘটেছে।
পিআইও অফিস সূত্রে জানা যায়, নতুন অর্থবছরের জন্য টিআর, কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পের আওতায় প্রায় আড়াই কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সৈয়দপুর উপজেলা। এর মধ্যে টিআর বাবদ ১ কোটি ১০ লাখ ৫৮ হাজার ৮৫৮ টাকা, কাবিখা বাবদ ১ কোটি ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৫৯০ টাকা আর কাবিটা বাবদ সাড়ে ৭৬ টন চাল ও সাড়ে ৭৬ টন গম বরাদ্দ হয়েছে (যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ৫৫ লাখ ৮ হাজার টাকা)। এই বরাদ্দের অর্ধেক বিল ইতোমধ্যে প্রথম পর্যায়ের জন্য প্রকল্প সভাপতিদের প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পিআইও এর কমিশন বাবদ ১০ শতাংশ কেটে নেয়া হয়েছে।
বেশ কয়েকজন প্রকল্প সভাপতি তথা ইউপি মেম্বারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী এবারও পিআইও অফিস খরচ বাবদ ১০ শতাংশ টাকা কেটে নিয়ে বাকি টাকা দিয়েছে। এক্ষেত্রে বিল ভাউচার তৈরীসহ ডিও লেটার সম্পন্ন করা, উপজেলা ট্রেজারী থেকে সেই বরাদ্দ অনুমোদন সাপেক্ষে চেক সংগ্রহ করা এবং ব্যাংক থেকে টাকা তুলে দেয়া ববাদ আরও অতিরিক্ত আড়াই হাজার টাকা প্রতিটি প্রকল্প বাবদ দিতে হয়। এই টাকা অফিসের নি¤œ পর্যায়ের স্ট্যাফরা নেয়। আর কমিশনের টাকা উপর মহল তথা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, নেতা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের খরচ বাবদ নেয়া হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউপি সচিব পর্যায়ের সুত্র এই কমিশন প্রদানের বিষয়ের সত্যতা স্বীকার করে বলেছে, এটা অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন থেকেই এই অনিয়ম চলে আসছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কথা বললেই সমস্যা। প্রকল্প প্রদানে জটিলতা সৃষ্টি করা সহ বিল প্রদানের ক্ষেত্রে নাকানি চুবানি খাওয়ায়। তাই প্রকল্প সভাপতিরা এই কমিশন দিয়ে ঝামেলা এড়িয়ে চলে। আর এই কমিশন দেয়া হলে কাজের মান নিয়ে পিআইও অফিস কোন বাগাড়ম্বর করেনা। অনেক ক্ষেত্রে কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা পাওয়া যায়। নয়তো ঠুনকো ত্রæিিট ধরে মাসের পর মাস বিল আটকিয়ে রাখাসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি করে।
আর এই কালচার চিরাচরিত হয়ে যাওয়ায় প্রশাসনের সর্বস্তরের কাছে এটা কোন অনিয়মই নয়। বরং এটাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। আর সেই কালচার অনুযায়ী বর্তমান পিআইও (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ লুৎফর রহমান প্রদত্ব বিলের অর্ধ্যেকের কমিশন বাবদ ১০ শতাংশ কেটে নিয়েছেন। অফিস সহায়ক মোঃ জয়নুল আবেদীনের মাধ্যমে এই কর্তনের কাজ করা হয়েছে। এতে প্রায় ১০ লাখ টাকা কর্তন করা হয়েছে। সুত্রটির আশঙ্কা কমিশন কেটে নেয়ার এই তথ্য প্রকাশ হলে পিআইও সহ অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আগামীতে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিল প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোরতার নামে হয়রানী করবে। তাই কোন প্রকল্প সভাপতি তথা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেম্বাররা বিষয়টি প্রকাশ করতে চাননা।
অভিযোগ উঠেছে, পিআইও এর এমন কমিশন নেয়ার সুযোগে প্রকল্প সভাপতিরা নামকাওয়াস্তে প্রকল্প সম্পাদন করছে। অনেক ক্ষেত্রে রাতের আধারে কোন রকমে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। বিশেষ করে রাস্তা মেরামত, মসজিদ-মাদরাসার টয়লেট নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ অত্যন্ত নি¤œমানের উপকরণ দিয়ে করা হচ্ছে। যা সহসাই নষ্ট হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর। এমনকি কিছু কিছু রাস্তা ঢালাইয়ের এক সপ্তাহের মধ্যে ডেবে গেছে এবং ফাটল ধরেছে। এক্ষেত্রে পিআইও অফিসের অফিস সহকারী মোঃ জয়নুল আবেদীন সহযোগিতা করছেন।
এব্যাপারে পিআইও অফিসের অফিস সহায়ক মোঃ জয়নুল আবেদীন বলেন, আমি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে কাজ করি। আর প্রকল্পের বিল ভাউচার তৈরী করে দিবেন প্রকল্প সভাপতিরা। কিন্তু তারা করতে পারেন না বলেই আমি তৈরী করে দিই। এর বিনিময়ে তারা কিছু সম্মানী দেয়। এটা আমি কাজের বিনিময়ে নিই। আর কমিশন কেটে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবোনা। পিআইও স্যারের সাথে কথা বলেন। তিনিই এর সঠিক জবাব দিতে পারবেন।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মোঃ লুতিফুর রহমান বলেন, কমিশন কেটে নেয়ার অভিযোগ মিথ্যে ও ভিত্তিহীন। কারো মাধ্যমেই এধরণের কোন লেন দেন আমার হয়নি। যারা অভিযোগ করেছেন তাদেরকে নিয়ে আমার অফিসে আসেন। আমি কিশোরগঞ্জ উপজেলায় মূল দায়িত্বে। সৈয়দপুরে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছি। তাই সৈয়দপুর অফিসে গেলে আমি ফোন দিবো তখন আসবেন। কিন্তু গত বুধবার থেকে আজ রবিবার পর্যন্ত তিনি অফিসে আসেননি। তাই এ বিষয়ে তার সর্বশেষ মন্তব্য জানা যায়নি। তবে জানা গেছে, তিনি আর আসবেন না। কারণ ইতোমধ্যে সৈয়দপুরে নতুন পিআইও নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার নুর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনারা জানিয়েছেন বিষয়টি আমি তদন্ত করে দেখবো। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে সুবিধা হয়। সত্যতা পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।





















