ড. প্রণব কুমার পান্ডে
শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে গবেষণা, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ততটা অগ্রসর হয়নি। একটি দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনের দক্ষতা তার অগ্রগতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বিশ্বমঞ্চে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভ্যন্তরে একটি শক্তিশালী গবেষণা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সবসময়ই গবেষণার চেয়ে শিক্ষণকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষাদানের প্রয়োজন থাকলেও জ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজকে মনে রাখা আবশ্যক। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আশেপাশের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম গবেষণাকর্ম পরিচালিত হয়। ফলে, দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কারণ বেশ কয়েকটি একাডেমিক সূচকে দেখা যাচ্ছে যে সম্মানজনক আন্তর্জাতিক গবেষণা জার্নালে বাংলাদেশের গবেষকদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা খুব কম। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রত্যাশিত গবেষণার ফলাফল অর্জিত না হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথমত, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। দুঃখজনকভাবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রায়ই গবেষণা তহবিলের চেয়ে পরিচালন ব্যয় বেশি হয়। এই আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা বড় আকারের গবেষণা উদ্যোগ শুরু করতে অক্ষম। চমৎকার গবেষণা চালানোর জন্য আধুনিক গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার এবং অন্যান্য গবেষণা সুবিধাও অপরিহার্য। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না থাকায় শিক্ষাবিদরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, গবেষণার তহবিল পাওয়া এবং বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মীদের সঙ্গে কাজ করা চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন।
অবশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রবণতা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে কারণ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক সময়ের চাহিদা মেটাতে গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছে। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জটিল আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কখনও কখনও গবেষণার জন্য অর্থ, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সম্পদের তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করে। এই আমলাতান্ত্রিক কাঠামো শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে জড়িত হতে বাধা দিতে পারে। ভাউচার তৈরির প্রয়োজনীয়তা শিক্ষকদের তহবিলের জন্য আবেদন করতে নিরুৎসাহিত করে।
ফলে ভবিষ্যতের শিক্ষাবিদদের গবেষণা দক্ষতা সফলভাবে বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতাসহ পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন গবেষক এবং পরামর্শদাতার অভাব রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এই পার্থক্যের একটি কারণ হলো বাংলাদেশি শিক্ষাবিদদের আন্তর্জাতিক গবেষণা মান এবং কৌশলগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত এক্সপোজারের অভাব। তাছাড়া, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প ক্ষেত্রের মধ্যে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বর্তমান বিশ্বে গবেষণা বিকশিত হয়। তবে বাংলাদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় মধ্যে সহযোগিতা খুব বেশি নেই। ফলে আমাদের দেশের খুব বেশি প্রয়োজনীয় গবেষণা নেই যা সৃজনশীলতা প্রচার করতে পারে এবং ব্যবহারিক সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে পারে।
এখন কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন গবেষণা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে? অর্থনীতির সম্প্রসারণ মূলত গবেষণা ও উদ্ভাবনের ওপর নির্ভরশীল। গবেষণার মাধ্যমে দেশের জিডিপি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা যেতে পারে কারণ গবেষণা আঞ্চলিক সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বিকাশ করতে পারে এবং পরিচালন প্রক্রিয়াগুলোর উন্নতি করতে পারে। তাছাড়া, গবেষণায় অংশগ্রহণ শিক্ষার মান উন্নত করে। যে শিক্ষার্থীরা গবেষণার সাথে যুক্ত থাকে তারা সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গভীর জ্ঞান বিকাশ করতে সক্ষম হয়।
তাছাড়া গবেষণার মাধ্যমে অনুষদ সদস্যদের তাদের কর্মক্ষেত্রের সাম্প্রতিকতম উন্নয়ন সম্পর্কে অবহিত হয়, যার ফলে তারা আরও ভালো শিক্ষাদান করতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা করতে হলে বাংলাদেশকে অবশ্যই অত্যাধুনিক ও উদ্ভাবনী গবেষণা পরিচালনা করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কেবল আন্তর্জাতিকভাবে সুনামই অর্জিত হবে না, বিদেশি বিনিয়োগ এবং অংশীদারিত্বও আকৃষ্ট হবে।
স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি এবং পরিবেশগত স্থায়িত্বসহ বর্তমান সামাজিক উদ্বেগের সমাধান গবেষণার মাধ্যমে করা যেতে পারে। বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে যদি তারা নির্দিষ্ট স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এমন সমস্যার কাস্টমাইজড সমাধান প্রদান করতে পারে।
অতএব বাংলাদেশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করতে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং বৈচিত্র্যময় পদ্ধতির প্রয়োজন। গবেষণা ও উন্নয়ন (আরঅ্যান্ডডি)-এর জন্য বরাদ্দকৃত সম্পদ বাণিজ্যিক ও সরকারি ক্ষেত্রগুলোর মাধ্যমে বৃদ্ধি করা উচিত। বিশেষ গবেষণা অনুদান এবং তহবিল তৈরি করার মাধ্যমে শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। বাইরের সহযোগিতা ও অর্থায়নের জন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করাও প্রয়োজন। অত্যাধুনিক পরীক্ষাগার নির্মাণ, আন্তর্জাতিক জার্নাল ও ডাটাবেজে প্রবেশাধিকারের নিশ্চয়তা এবং শিক্ষাবিদদের তাদের গবেষণা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম প্রদান সবই সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিকাঠামো উন্নয়নের অংশ। গবেষণা কেন্দ্র এবং উৎকর্ষ কেন্দ্রগুলো চমৎকার অধ্যয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে।
দক্ষতার কার্যকর অপ্টিমাইজেশন এবং গবেষণা প্রক্রিয়ার দক্ষ সুবিন্যস্তকরণের জন্য প্রশাসনিক উন্নতি প্রয়োজন। প্রশাসনিক বাধাগুলো দূর করা যেতে পারে যাতে গবেষকরা তাদের কাজে আরও বেশি মনোনিবেশ করতে পারেন এবং গবেষণার তহবিল ও সম্পদ অর্জনে কম সময় ও শক্তি ব্যয় করতে পারেন। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই লক্ষ্য করে পেশাদারিত্ব বিকাশের উদ্যোগগুলো তাদের গবেষণা দক্ষতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে পারে। এই কোর্সগুলোতে গবেষণা পদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ নির্দেশনা, অনুদানের দরপত্র লেখার দক্ষতা এবং মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক জার্নালে একাডেমিক গবেষণাপত্র প্রকাশের প্রক্রিয়া অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাছাড়া, আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত গবেষকদের প্রশিক্ষণ এবং নতুনদের সহায়তা করার জন্য মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করা একটি সহায়ক গবেষণা পরিবেশ তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে।
ব্যবহারিক গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পের মধ্যে দৃঢ় অংশীদারিত্ব সম্ভাবনার ব্যাপক বৃদ্ধি করতে পারে। ইন্টার্নশিপ, শিল্প-পৃষ্ঠপোষক গবেষণা কর্মসূচি এবং সমবায় গবেষণা প্রকল্পগুলো এটি করতে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া, এই সহযোগিতাগুলো নিশ্চয়তা দিতে পারে যে গবেষণায় বাস্তবতার প্রয়োগ রয়েছে এবং শিল্পের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমন একটি সংস্কৃতির বিকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ যা অধ্যয়নকে সমর্থন করে এবং পুরস্কৃত করে। পুরস্কার প্রদান, প্রচার এবং অন্যান্য ধরনের স্বীকৃতি গবেষণার সাফল্যকে স্বীকৃতি দিতে এবং অনুপ্রাণিত করতে সাহায্য করতে পারে। ফলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অবশ্যই তাদের প্রচারমূলক নীতিগুলি সংশোধন করতে হবে যাতে উচ্চমানের গবেষণার প্রকাশনাকে প্রচারের পূর্বশর্ত হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, কারণ এই কার্যক্রম বর্তমানে অনুপস্থিত। থিসিসের প্রয়োজনীয়তা এবং স্নাতক গবেষণা কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গবেষণা মনোভাবও গড়ে তোলা যেতে পারে, যা গবেষণা কার্যক্রমে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করবে।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাকে সমর্থন করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয় না। ফলে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উদ্ভাবন ও জ্ঞান উৎপাদনের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। ফলে, সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার অগ্রগতির পাশাপাশি এই পরিবর্তন দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও বৈজ্ঞানিক মর্যাদাকে উন্নত করবে। ইতিবাচক গবেষণার পরিবেশ গড়ে তুলতে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্মুক্ত করতে সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও বিদেশি অংশীদারদের মধ্যে সহযোগিতা অপরিহার্য।
লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়