বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয়!

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুর শাসনের অধীনে নিপীড়ন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ স্বাধীনতা অর্জন করার পর থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অগ্রগতির ধারাকে অক্ষুন্ন রাখার লড়াইয়ে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে। শত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বাঙালি জাতি তাদের নিজস্ব পথ নির্ধারণ করতে বদ্ধপরিকর ছিল। তবে, দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথ বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক গোষ্ঠীর দ্বারা উত্থাপিত বিভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জে ভরা। বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে। তবুও বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সুনাম নষ্ট করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা এটা ইঙ্গিত দেয় যে দেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয় রয়েছে। ফলে, এই ঘৃণ্য কার্যকলাপ প্রতিহত করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে বাংলাদেশের সূচনা থেকেই একটি গোষ্ঠী দেশের সরকারকে অস্থিতিশীল করার এবং এর অগ্রগতিতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত জাতি দেশের ভিতর এবং বাইরে থেকে বিভিন্ন ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, পুরনো শাসনের অবশিষ্ট অংশ এবং বিদেশি স্বার্থ দেশের ভঙ্গুর অবস্থাকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। তবে, বিভিন্ন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী জাতির ভিত্তি স্থাপন হয়েছিল।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্নির্মাণের বিশাল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় রাজনৈতিক হত্যা, অভ্যুত্থান এবং অর্থনৈতিক নাশকতার আকারে ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড দেশকে অস্থিতিশীল করতে ষড়যন্ত্রকারীরা কতদূর যেতে পারে তার একটি স্পষ্ট অনুস্মারক ছিল। এই সময়কালে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, যা দেশের অগ্রগতিকে আরও বাধাগ্রস্ত করে।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের যাত্রাপথে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর নেতৃত্ব দেশকে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে চালিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। এই সাফল্য সত্ত্বেও, ষড়যন্ত্রমূলক উপাদানগুলো সরকারকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে বিশ্বে সর্বোচ্চের মধ্যে রয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির হার অর্জনে বস্ত্র ও পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শক্তিশালী উৎপাদন ক্ষেত্র ভূমিকা রেখেছে। সরকার দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবার মানোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।

এই সাফল্য সত্ত্বেও দেশের একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারকে অসম্মান করতে বদ্ধপরিকর। এই গোষ্ঠীগুলো প্রায়ই বাহ্যিক সমর্থনে দেশের অগ্রগতিকে দুর্বল করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তাদের কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে ভুল তথ্য ছড়ানো, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা এবং দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করা। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অপবাদমূলক তথ্য ছড়ানো এই ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক প্রচেষ্টার একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান জাতীয় গর্বের উৎস। দেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বজুড়ে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে তাদের পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা এবং কার্যকারিতার জন্য প্রশংসিত হয়ে আসছে। তবে, এই কষ্টার্জিত সুনামকে কলঙ্কিত করার অভিপ্রায়ে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া হাউস তাদের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে অভিযোগ করেছে যে বাংলাদেশ সরকার অতীতের নৃশংসতার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করেছে।

এই অভিযোগের উদ্দেশ্য কেবল সরকারকে অসম্মান করা নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিশ্বাসযোগ্যতা হ্রাস করা। এই ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের সুদূরপ্রসারী পরিণতি হিসেবে জাতিসংঘে দেশের অবস্থানকে বিপন্ন করতে পারে এবং বৈশ্বিক শান্তি প্রচেষ্টায় বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের অবদানকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

এই অভিযোগের সময় এবং প্রকৃতি সরকারকে অস্থিতিশীল করার একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়। এই ধরনের প্রতিবেদনের পেছনে উদ্দেশ্যগুলো প্রায়ই অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই সরকারের অবস্থানকে দুর্বল করার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিহিত থাকে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সততার ওপর অপবাদ দিয়ে, এই ষড়যন্ত্রকারীরা সরকার এবং এর উদ্যোগের প্রতি জনসাধারণের আস্থা হ্রাস করার প্রত্যাশা করছে বলেই মনে হয়।

এই ধরনের ষড়যন্ত্রের মুখে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গ্রহণ করা অপরিহার্য। এই প্রচেষ্টাগুলোর মোকাবিলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যার মধ্যে কূটনৈতিক, তথ্যমূলক এবং আইনি কৌশল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই অভিযোগগুলো মোকাবিলা ও খণ্ডন করার জন্য সরকারকে অবশ্যই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাথে আলোচনা করতে হবে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের পেশাদারিত্ব ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা উচিত। আন্তর্জাতিক জোটকে শক্তিশালী করে এবং সহযোগিতা জোরদার করে বাংলাদেশ ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা প্রচারিত নেতিবাচক গল্পকে প্রতিহত করতে পারে।

অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে ষড়যন্ত্রকারীরা ডিজিটাল জগতকে বেছে নেয়। ফলে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালাতে হবে। ভুল তথ্য ও অপপ্রচার কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে সরকারের উচিত তথ্য যুদ্ধ সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করা। এর মধ্যে রয়েছে একটি শক্তিশালী গণমাধ্যমের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠা করা, সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে কাজে লাগানো এবং দেশের অর্জন ও অবদান সম্পর্কে বাস্তব ও ইতিবাচক বিবরণ উপস্থাপন করতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।

রাষ্ট্রকে দুর্বল করার লক্ষ্যে কার্যকলাপে জড়িত ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই ধরনের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিহত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে রয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।

দেশকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে অসংখ্য ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও, বাংলাদেশ অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। তবে এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের সুনাম নষ্ট করার সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা প্রমাণ করে যে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয় এবং অবিচল। দেশের সাফল্য রক্ষা করতে এবং অব্যাহত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে, এই ষড়যন্ত্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার, তথ্য যুদ্ধের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী আইনি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার ষড়যন্ত্রকারীদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন রাখবে বলেই সকলে আশা করে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি