স্মার্ট বাংলাদেশ: কার্ডেই লেনদেন মাসে ৫০ হাজার কোটি টাকা 

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থনীতির গতি বাড়িয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ থাকবে নগদ লেনদেন থেকে দূরে। সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ টাকার ব্যবহার কমাতে আগে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার-সুবিধা চালু করেছে। এছাড়া রয়েছে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচের অধীন এটিএম, পয়েন্ট অব সেলস লেনদেন, কার্ডে লেনদেন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং ফান্ড ট্রান্সফার-সুবিধা। এসব কিছু হচ্ছে শুধুমাত্র ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা স্মার্ট করার ফলে এখন কার্ডে লেনদেন মাসে ছাড়িয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা।    

গত মার্চ মাসে কার্ডে মোট ৫২ হাজার ৮৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এই অঙ্ক একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ। এর আগে কখনই এক মাসে কার্ডের মাধ্যমে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি লেনদেন হয়নি। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে লেনদেন হয়েছিল ৪৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। আর গত বছরের মার্চে এই অঙ্ক ছিল ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা।

এদিকে কার্ডের ব্যবহারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, বছরের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৭১ লাখ। গত এপ্রিলে ঈদের আগে রমজান ও ঈদকে কেন্দ্র করে মার্চ মাসে কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। সামনে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখেও লেনদেন বাড়বে বলে আশা করছেন তারা।

ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এখনো দেশের বড় অংশের মানুষের ব্যক্তিগত লেনদেন নগদ টাকায় সম্পন্ন হচ্ছে। তবে দিনকে দিন কার্ডে লেনদেন বাড়ছে। লেনদেনের সহজ মাধ্যম হিসেবে কার্ড দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ব্যাংকগুলোও এ খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন সেবা নিয়ে এসেছে।

কার্ড কিংবা অ্যাপ ব্যবহার করে কেনাকাটা, বিভিন্ন ইউটিলিটি বিলসহ সহজে বিভিন্ন পরিশোধ করা যায়। টাকা উত্তোলন ও জমাও করা যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশ কিংবা বিদেশে হোটেল বুকিং থেকে নানা বিল পরিশোধ করা যায়। এতে ঝামেলা কম। আবার অনেক সময় নানা ছাড় মিলছে। বিশেষ করে উৎসবের আগে কেনাকাটায় বিভিন্ন অফার দেয় ব্যাংক ও মার্চেন্ট।

কার্ড বা অ্যাপের মাধ্যমে নিজের সুবিধামতো সময়ে মুহূর্তে টাকা স্থানান্তর করা যাচ্ছে। এ ব্যবস্থায় লেনদেনে জাল নোট এবং পকেটমারের ঝুঁকি নেই। আবার ব্যাংকে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা নেই। এসব কারণে অনেকেই এখন কার্ড লেনদেন বেছে নিয়েছেন। অবশ্য কার্ডের লেনদেনে বাড়তি সতর্কতা ও সচেতনতা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে কার্ড থেকে মোট লেনদেনের মধ্য স্থানীয় মুদ্রায় হয়েছে ৫১ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আগের মাসে যা ছিল ৪৪ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এর আগে এক মাসে স্থানীয় মুদ্রায় সর্বোচ্চ ৪৮ হাজার ৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয় গত বছরের জুনে। সব মিলিয়ে ওই মাসে কার্ডে লেনদেন হয় ৪৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা, যা ছিল কোনো একক মাসে সর্বোচ্চ। বৈদেশিক মুদ্রায় গত মার্চে ৭২৩ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আগের মাসে যা ছিল ৭৭২ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রায় এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯২৯ কোটি টাকা লেনদেন হয় গত বছরের ডিসেম্বরে।

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৪০ লাখ ১৭ হাজার। গত বছরের মার্চ শেষে ছিল ৩ কোটি ৬৯ লাখ ২১ হাজার। অর্থাৎ গত এক বছরে কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭১ লাখ।

ব্যাংকগুলোর ইস্যু করা মোট কার্ডের বেশির ভাগই ডেবিট কার্ড। গত মার্চ পর্যন্ত ডেবিট কার্ড দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার। গত বছরের একই মাস শেষে ছিল ৩ কোটি ১ লাখ। ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা গত বছরের মার্চের ২১ লাখ ৭৮ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ লাখ ৫১ হাজার। আর প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫৬ লাখ ৯৭ হাজার। ২০২৩ সালের মার্চ শেষে যা ছিল ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার।

কার্ড থেকে স্থানীয় মুদ্রায় লেনদেনের বেশির ভাগই হয়েছে ডেবিট কার্ড থেকে। গত মার্চে ডেবিট কার্ড থেকে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ১০১ কোটি টাকা। ক্রেডিট কার্ডে লেনদেন হয় ৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। আর প্রিপেইড কার্ডে ৪৬৭ কোটি টাকা।

বেসরকারি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, দিন যতো যাচ্ছে কার্ডের লেনদেন বাড়ছে। মানুষ ঝামেলা ছাড়া লেনদেন করতে চায়, সময় বাঁচাতে চায়। কার্ডভিত্তিক লেনদেনের তথ্য থেকেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, স্মার্ট বাংলাদেশে নগদ অর্থের ব্যবহার একেবারে কমিয়ে আনতে হবে। কারণ সারা বিশ্ব এই পথেই হাঁটছে। প্রতি বছর কেবল টাকা ছাপতেই সরকারের ৫০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। তাছাড়া এই টাকার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ, লেনদেনের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা এবং তার ফলে যে সম্ভাবনার অপচয় হয় সেটির মূল্য অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকা। নগদ অর্থের নির্ভরতা কমিয়ে আনলে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ই-কমার্স ব্যবসা এবং বিদেশি ভ্রমণের বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কার্ডের লেনদেন বেড়েছে, মহামারির মধ্যে এটি আরও গতি পেয়েছিলো। ডেবিট, ক্রেডিট এবং প্রিপেইড কার্ডের সংখ্যার পাশাপাশি কার্ডের মাধ্যমে লেনদেনও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ থেকে জানুয়ারি ২০২৩ এই সময়ের মধ্যে ডেবিট কার্ডে লেনদেন ১৭৭ শতাংশ, ক্রেডিট কার্ডে ১২৫ শতাংশ এবং প্রিপেইড কার্ডে ২০০ শতাংশ বেড়েছে।

গত বছরের নভেম্বরে ‘টাকা পে’ কার্ড চালুর মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে। ‘টাকা-পে’ হল এক ধরনের ডেবিট কার্ড। এ কার্ডের মাধ্যম প্রচলিত ভিসা বা মাস্টার কার্ডের মতই লেনদেন করতে পারবেন গ্রাহকরা। বাংলাদেশের ভেতরে বিভিন্ন ব্যাংক এই কার্ড ইস্যু করতে পারবে, নিয়ন্ত্রণ থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১ নভেম্বর এই কার্ডের উদ্বোধন করেন।

দেশে এখন যতগুলো কার্ড ব্যবহার হচ্ছে তার সবগুলোই বিদেশি কোম্পানির তৈরি। একটি নির্দিষ্ট ফি’র বিপরীতে ব্যাংকগুলো এই কার্ড সেবা দিয়ে আসছে। এতে এক ব্যাংকের ইস্যু করা কার্ড অন্য ব্যাংকের এটিএম বুথে লেনদেন করতে বাড়তি খরচ দিতে হয়। এছাড়া বছর শেষে গ্রাহককে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত কার্ড ব্যবহারের ফি দিতে হয় ব্যাংকগুলোকে। তার সঙ্গে রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট।

গ্রাহকদের কাছ থেকে ব্যাংকের নেওয়া ফি’র একটি অংশ পায় কার্ড মালিক বিদেশি মালিকানা প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা চলে যায়। কিন্তু ‘টাকা-পে’ কার্ড পরিচালিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি) এর মাধ্যমে। ফলে এই কার্ড যে কোনো এটিএম বুথে সহজে লেনদেন করা যাবে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ও নির্বিঘ্নে লেনদেন করা যাবে।

ডেবিট কার্ড দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে ক্রেডিট ও আন্তর্জাতিক কার্ড তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ‘টাকা-পে’ কার্ডের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে ডুয়েল কারেন্সি বা দ্বৈত মুদ্রা ব্যবহার করা যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশী নাগরিকরা ভারতে গেলে এই কার্ডের মাধ্যমে রুপি ব্যবহার করতে পারেন, যার ফলে টাকার সঙ্গে বিনিময় হচ্ছে রুপি। এতে করে ডলারের ওপর চাপ কমছে।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি