সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার এফএস শাখা যেন টর্চার সেল

দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার ফাইনাল সেটেলমেন্ট (এফএস) শাখা যেন টর্চার সেল। এখানে অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের নানা অজুহাতে হয়রানী করাসহ মানসিক নির্যাতন করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অবৈধ আর্থিস সুবিধা নেয়ার জন্য এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ শ্রমিককে শায়েস্তা করার জন্য এখানে ভোগান্তিতে ফেলা হয় সেবা নিতে আসা শ্রমিক কর্মচারীদের। ফলে এমন কোন রেলওয়ে কর্মচারী নেই যারা এই শাখার নিষ্পেষনের শিকার হয়নি। কর্মজীবন শেষে জীবনের শেষ সম্বল সার্বিক সঞ্চয় প্রাপ্তির জন্য এসে এখানকার গ্যাড়াকলে পড়ে সবাই বাধ্য হয় এই কার্যালয়ের দাবি মেটাতে। এতে অনেকে কঠিন দূর্ভোপ পোহানোসহ নিস্ব হয়ে দিনের পর দিন কাটিয়েছেন। সম্প্রতি এই কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উচ্চমান সহকারীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করতে গেলে সত্যতা পাওয়ায় সংবাদকর্মীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে অন্যত্র বদলী করা হয়েছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের দাবি বিগত দিনে তার সকল অবৈধ আয় এবং কৃত অন্যায়ের বিভাগীয় সঠিক বিচার করতে হবে। নইলে সে যেখানেই থাকবে সেখানেই তার অপরাধ করে যাবে।
এরকম একজন ভুক্তভোগী রেলওয়ে কারখানার ক্যারেজ সপের শ্রমিক আলাউদ্দিন বলেন, আমি অবসর পূর্ব ছুটিকালীন (এলপিআর) আমার কর্মজীবনের চুড়ান্ত হিসেব নিকেশ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এফএস শাখায় গেলে সেখানে দায়িত্বরত উচ্চমান সহকারী শাহাদাত হোসেন (সোহন) আমার কাছে উৎকোচ দাবি করেন। এতে সম্মত না হওয়ায় তিনি রেলওয়ে শ্রমিকলীগ সাধারণ সম্পাদক ও সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিনের সাথে দেখা করতে বলেন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার বিষয়ে তার অভিযোগ রয়েছে তাই তার অনুমতি ছাড়া আমি আপনার প্রতিবেদন দিতে পারবোনা। তাছাড়া আপনি মোখছেদুল মোমিনের জামাই মিল রাইট সপের কর্মচারী মাহাবুব ইসলাম ওরফে জামাই এর সাথে দেখা করে আপনার কোয়াটার নিয়ে সৃষ্ট ঝামেলার সমাধান করেন। তা না হলে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে অসুবিধা হবে। পরে বিষয়টি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার বিভাগীয় তত্বাবধায়ক সাদেকুর রহমান মহোদয়কে জানানোর পরও কোন সুরাহা পায়নি। দীর্ঘ প্রায় ৬ মাস এজন্য চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাকে। বাধ্য হয়ে সরাসরি ঢাকায় গিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়িজ লীগ (বিআরইএল) এর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় রেলভবন থেকে বিষয়টি সমাধান করি।
তিনি আরও বলেন, মূলতঃ কর্মজীবনে বিআরইএল এর সাথে সম্পৃক্ত থাকায় শ্রমিকলীগ নেতা প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে এই হয়রানী করেন। আর উচ্চমান সহকারী তার ভাগিনা হওয়ায় সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাকে হেনস্থা করেছেন। সেই সাথে উৎকোচ দাবি করেছেন। তার মন্তব্য হলো এভাবে ভিন্নমতের তথা অন্য শ্রমিক সংগঠন করার কারণে অনেকেই মোখছেদুল মোমিন ও তার ভাগিনার এবং জামাই মাহবুবের কাছে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন। তাছাড়া অবসরে যাওয়া সব শ্রমিকই তাদের দ্বারা মানসিক নির্যাতনের এবং আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
একইভাবে অভিযোগ করেন ক্যারেজ সপের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী বজলুর রহমান। তিনি বলেন, এফ এস শাখা যেন মানসিক টর্চার সেল। সারাজীবন কাজ করে আসার পর অবসরের প্রাক্কালে এই শাখায় এসে দূর্বিসহ মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়। এখানে উৎকোচ দেয়া ছাড়া চুড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া দুষ্কর। ঠুনকে অজুহাতে মাসের পর মাস ফাইল আটকে রেখে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় উচ্চমান সহকারী শাহাদাত হোসেন। অভিযোগ রয়েছে এই শাহাদাত রেলওয়ে কারখানার শ্রমিকলীগ নেতা মোখছেদুল মোমিনের ভাগিনা হওয়ায় তার মাধ্যমে অবসরে যাওয়া শ্রমিকদের শোষণ করে আদায়কৃত টাকার ভাগ নেন মোখছেদুল মোমিন। এজন্যই শাহাদাতকে এখানে বসিয়েছেন তিনি। মোখছেদুল মোমিন দীর্ঘদিন আগেই অবসর নিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হলেও কারখানায় তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এভাবে বিভিন্ন শেকসনে নিজের লোক বসিয়ে রেখেছেন। যাদের মাধ্যমে উপরি টাকা উপার্জনসহ নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে রেলওয়ে কারখানাকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। আর তার সহযোগি হয়ে কাজ করছেন ওইসব কর্মচারী। পাশাপাশি তারাও লাভবান হচ্ছেন অবৈধ টাকা উপার্জনে।
হাফিজুল ইসলামন নামে একজন কর্মচারী বলেন, শ্রমিকরা অবসরে গিয়ে সাচ্ছন্দে দিন কাটাতে অপেক্ষায় থাকে জীবনের শেষ সঞ্চয়টকু সহজে পেতে। কিন্তু এফএস শাখায় নিজে গিয়ে কাজ করতে চাইলে হয়না। আজিজ নামে একজন দালালের শ^রণাপন্ন হতে হয়। তার দ¦ারা ফাইল পুটআপ না করলে উচ্চমান সহকারী তা গ্রহণই করতে চান না। বাধ্য হয়ে ওই দালালের মাধ্যমে ফাইল জমা দিতে হয়। অহেতুক ত্রুটির কথা বলে ওই দালালকে দিয়েই তা সংশোধনের জন্য মোটা অংকের উৎকোচ দাবি করা হয়। তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেই মাসের পর মাস আটকে থাকে ফাইল। আর যদি টাকা দেয়া হয় তাহলে দ্রুতই সম্পন্ন হয় চুড়ান্ত প্রতিবেদন। নয়তো ঝুলে থাকে। এটা অত্যন্ত কষ্টকর অভিজ্ঞতা। এথেকে পরিত্রাণ চায় কারখানার সর্বস্তরের শ্রমিক কর্মচারীরা।
এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংবাদকর্মীরা সরেজমিনে এফএস শাখায় গেলে দেখতে পাওয়া যায় যে, অভিযুক্ত উচ্চমান সহকারী শাহাদাত হোসেন, ইচ্ছেমত অফিসে আসেন। নির্ধারিত টিফিন পিরিয়ড শেষ হওয়ার প্রায় ২ ঘন্টা পরও তিনি অফিসে না আসায় মোবাইলে কল দিয়ে তাকে ডেকে আনা হয়। এসময় তিনি অভিযোগের বিষয়ে নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। পরে অভিযোগকারী আলাউদ্দিনের সাথে মুঠোফোনে কথা বলানো হলে, আলাউদ্দিন সরাসরি তাকে অভিযুক্ত করলে শাহাদাত হোসেন চুপসে যান এবং কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এর কয়েকদিন পর এ বিষয়ে যেন কোন নিউজ করা না হয় এবং বিষয়টি যেন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো না হয় সেজন্য তার এক নিকট আত্মীয় বিএনপি নেতার মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ প্রদানের মাধ্যমে সংবাদকর্মীদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন শাহাদাত হোসেন। কিন্তু তাতে কোন সুবিধা করতে পারেননি তিনি।
পরবর্তীতের এব্যাপারে কারখানার কর্মব্যবস্থাপক (ডাব্লু এম) ও বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত (অতিরিক্ত) বিভাগীয় তত্বাবধায়ক শেখ হাসানুজ্জামানকে অবগত করা হলে তিনি তদন্ত সাপেক্ষ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান। এসময় তিনি বলেন, শাহাদাত যে বাংলো বরাদ্দ নিয়ে বসবাস করছেন তা নেয়ার পর প্রায় এক বছর যাবত ভাড়া বাবদ ৪০ শতাংশ টাকা কর্তনের ক্ষেত্রে মাত্র ৫ শতাংশ কাটা হওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তবে সত্যতা মিললে সে ব্যাপারেও নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নিয়ে সমুদয় অর্থ কর্তন করা হবে।
কারখানা সুত্রে জানা যায়, অভিযোগের তদন্ত শেষে সত্যতা পাওয়ায় শাহাদাত হোসেনকে গত বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) এফএস শাখা থেকে টাইম অফিসে বদলী (ট্রান্সফার) করা হয়েছে। কিন্তু তার ইতোপূর্বে করা উৎকোচ গ্রহণ, শ্রমিকদের হয়রানী, দায়িত্বের অবহেলা তথা অনিয়ম দুর্ণীতির বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা আইনগত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সুত্রটির অভিযোগ এসবের সাথে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত থাকায় অথবা জানার পরও অজ্ঞাত কারণে নিরব থাকায় এখন শাহাদাতের বিরুদ্ধে কঠোর কোন পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। কারণ শাহাদাতের বিষয়ে তাদের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে এবং তাতে তারাও ফেসে যাবেন দায়িত্বহীনতা বা অনিয়মের সহযোগি হিসেবে। তাই আপাতত তাকে অন্যত্র সরিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করেছেন কর্তৃপক্ষ।
এমতাবস্থায় ভোগান্তির শিক্রা অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারীরা সহ বর্তমানে কর্মরত সাধারণ শ্রমিকরা দাবি জানিয়েছেন যে, অনতিবিলম্বে শাহাদাত তথা এফএস শাখা নামক টর্চার সেলের কুকর্মের সার্বিক তদন্তপূর্বক এর সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হোক। নয়তো আগামীতে আবারও তাদের নিষ্পেষনের শিকার হতে হবে অবসরে যাওয়া সকলকে। যা কোন ভাবেই আর মেনে নেওয়া যায়না। এব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তারা রেলওয়ের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

  • Related Posts

    ৪৬তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ-২০২৫ সৈয়দপুরে দুই দিনব্যাপী বিজ্ঞান মেলার সমাপণী ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত

    নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৪৬তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহ-২০২৫ উপলক্ষে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বিজ্ঞান মেলা সমাপ্ত হয়েছে। সৈয়দপুর উপজেলা প্রশাসন আয়োজনে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যাদুঘরের তত্ত্বাবধানে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি…

    Continue reading
    শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি সৈয়দপুর শাখার উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ

    শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি নীলফামারীর সৈয়দপুর শাখার উদ্যোগে শীতবস্ত্র (কম্বল) বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল রোববার (১২ জানুয়ারি) রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের ফাজিলপুর খিয়ারজুম্মা দোয়ালিপাড়া তকেয়া মদিনাতুল উলুম কওমী মাদ্রাসার…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি