‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-নাতনিরা পাবে?- এমন প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন সন্ধ্যার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে  ছড়াতে থাকে, ‘আন্দোলনকারীদের রাজাকারের নাতি নাতনি’ বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে একজন সাংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সামাজিকমাধ্যমসহ বিভিন্ন জায়গায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করা হচ্ছে, হেয় করা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, `বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? তারা দেশ স্বাধীন করার জন্য জীবনপণ লড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় কীভাবে? মুক্তিযুদ্ধ তাদের এখন ভালো লাগে না।‘

এখানে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্ট করে তাদেরকেই কথাগুলো বলেছিলেন যারা হেয় করছেন বা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, `মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে। তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না। অপরাধটা কী? নিজের জীবনবাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে। বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন।‘

যার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক স্লোগান ‘আমি কে, তুমি কে, বাঙালি বাঙালি’- কে বিকৃত করে ‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলে স্লোগান দেওয়া শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসিমউদ্দিন হলসহ আরও কয়েকটি হলে। এমন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলে বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা রাত পৌণে ১২ টার দিকে রাস্তায় নেমে আসে। এই একই স্লোগান দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। 

এমন ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা রাজাকার বলে স্লোগান দিচ্ছে তারা কি মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাস জানে? মুক্তিযুদ্ধের পাশবিকতা তারা দেখে নি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না। দুর্ভাগ্য, তারা কি শিখলো?’

আন্দোলনকারিদের এমন আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নানা সংগঠন। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্লোগান দিয়ে নিজেদের ‘রাজাকার’ দাবি করা শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানিয়েছে শহীদ পরিবারের সন্তানেরা। সোমবার (১৫ জুলাই) শাহবাগে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে শহীদ পরিবারের সন্তান রহমান মুস্তাফিজ বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ১৯৭১ সালে মীমাংসিত হয়ে গেছে। তারপরও স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসে নিজেদের রাজাকার বলে দাবি করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমরা এই স্বঘোষিত রাজাকারদের চিহ্নিত করে শাস্তি ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি জানাই।

কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীরা রবিবার বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়। স্মারকলিপি দেওয়ার আগের দিন শনিবার নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে সরে আসে আন্দোলনকারীরা। কোটা সংস্কারের দাবিতে ক্লাস – পরীক্ষা বর্জন এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। তাদের দাবি – ‘৫ শতাংশ কোটা পদ্ধতি চাই। আমরা মুক্তিযোদ্ধা কোটাবিরোধী নই। নাতি-নাতনিরা পাবে, আমরা এটা চাই না। সন্তান পর্যন্ত ঠিক আছে। আমরা চাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা এবং মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের জন্য কোটা থাকবে।’ 

২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনেও এমন ঘটনা দেখা গেছে। ‘রাজাকার’ বলা ইস্যুকে কেন্দ্র করে থেমে যাওয়া আন্দোলন পুনরায় চাঙ্গা করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিলে চলমান আন্দোলনের সময় সোমবার (৯ এপ্রিল) সকাল ১১টায় আন্দোলনকারীদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের প্রতিনিধিরা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহঙ্গীর কবির নানক আগেরদিন রবিবার (৮ এপ্রিল) রাত দেড়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে গিয়ে আন্দোলনকারীদের এ বৈঠকের প্রস্তাব দেন। বৈঠকে সাড়া দিয়ে সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার পর ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করে আন্দোলনকারীরা।

কিন্তু পরদিন আবারও অন্য ইস্যুতে রাস্তায় নেমে যায় আন্দোলনকারীদের একাংশ। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের প্রতিবাদে আবারও মাঠে নামার ঘোষণা দেন তারা। মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) সন্ধ্যা পৌণে ৬টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মো. রাশেদ খান এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। এসময় সেখানে যোগ দেন সোমবার সন্ধ্যা থেকে টিএসসির সামনে অবস্থান নিয়ে আলাদাভাবে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীরাও। সংবাদ সম্মেলনের পর ঢাবির টিএসসির সামনের সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্য ঘিরে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। 

সংবাদ সম্মেলনেন সমন্বয়ক রাশেদ খান বলেন, ‘গতকাল সোমবার আমরা সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত থাকবে। কিন্তু একই সময়ে জাতীয় সংসদে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদেরসহ ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে রাজাকারের বাচ্চা বলে গালি দিয়েছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আমরা এ বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য আজ  মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য দেননি। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আজ ঘোষণা দিয়েছেন আগামী বাজেটের আগে কোটা সংস্কার করা হবে না। সংস্কার নিয়ে তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, খুব দ্রুত কোটা সংস্কারে তাদের কোনও চিন্তা ভাবনা নেই। এ কারণে আমরা আবার আমাদের নিয়মিত কর্মসূচিতে ফিরে যাচ্ছি।’ তিনি এ সময় সারাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং অবরোধের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

সেদিনের সংসদ অধিবেশনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছিলেন, ‘পরিষ্কার বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে। রাজাকারের বাচ্চাদের আমরা দেখে নেবো। তবে ছাত্রদের প্রতি আমাদের কোনও রাগ নেই। মতলববাজ, জামায়াত-শিবির, তাদের এজেন্টদের বিরুদ্ধে সামান্য শৈথিল্য দেখানো হবে না।’

মতিয়া চৌধুরী সুনির্দিষ্ট করে বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের প্রতি আমাদের কোন রাগ নেই’ । তারপরও ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে আবারো পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা হয়।

এই ঘটনার দুইদিন পর সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন পর তো আবার আরেক দল এসে বলবে, আবার সংস্কার চাই। তো কোটা থাকলেই সংস্কার। আর না থাকলে সংস্কারের কোনও ঝামেলাই নাই। কাজেই কোটা পদ্ধতি থাকারই দরকার নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ মানুষ বারবার কষ্ট পাবে কেন? এই বারবার কষ্ট বন্ধ করার জন্য আর বারবার এই আন্দোলন-ঝামেলা মেটানোর জন্য কোটা পদ্ধতিই বাতিল। পরিষ্কার কথা। আমি এটাই মনে করি, সেটা হলেই ভালো।’

প্রধানমন্ত্রীর সংসদে ঘোষণা দেওয়ার পর আন্দোলন স্থগিত করা হয়, ক্যাম্পাসে আনন্দমিছিল করা হয়। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘মাদার অব এডুকেশন’ বলে অভিহিত করেন।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে বিকৃত ও খণ্ডিত করে প্রচার করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের একাংশ বিশৃঙ্খল সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি বলছেন, প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেননি।…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি