বিপ্লব কুমার পাল
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব ৫৩ বছরের। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে ভারতবিরোধীতা বাড়তে থাকে। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে এই বিদ্বেষ প্রকাশ আরও বেড়েছে। কিছুদিন আগেও ‘ইন্ডিয়া বয়কট’ নিয়ে রীতিমত যুদ্ধ চলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই ‘ইন্ডিয়া বয়কট’ ক্যাম্পেইনের অভিযোগ- বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভারত হস্তক্ষেপ করেনি, সরকারের সব কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়েছিল। এরআগে ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের হারে উল্লসিত হয়ে, কুরুচিপূর্ণ কমেন্ট করে, কনটেন্ট বানিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
ভারতে কিছু হলেই যেন কিছু মানুষের অনুভূতি ব্যাপক নাড়া দিয়ে উঠে। ভারতে গরুর মাংস বিক্রির কারণে পিটিয়ে হত্যার আঁচ পড়ে বাংলাদেশে। সেখানে মসজিদে কিছু হলে এর ঝাল পোহাতে হয় বাংলাদেশের সনাতন ধর্মালম্বীদের। ভারতের কোথায় কোনো সাম্প্রদায়িক অন্যায় হলে এর প্রতিশোধ নিতে বেছে নেয়া হয় বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। সেটি হোক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা সামনাসামনি। শহরে সাম্প্রদায়িক আঁচ কিছুটা কম পাওয়া গেলেও গ্রামে কিন্তু এর ভয়াবহতা অনেক বেশি থাকে। তাই দেশে জনসংখ্যার হার বাড়লেও, কমছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হার।
ভারতের মতো অন্যায় অন্য কোনো দেশে হলে আমাদের ‘কিছু’ মানুষের অনুভূতিতে খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর গণহত্যা এবং নির্যাতন চলছে। কিংবা মিয়ানমারে নির্বিচারে মুসলিম রোহিঙ্গারে হত্যা করা হচ্ছে। এনিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কথা নেই। ভারতের মুসলমান শুধু মুসলমান! চীন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা যেন মুসলমান নয়! একই ভাবে হেলানো মিনারের জন্য বিখ্যাত ইরাকের মসুলের প্রাচীন গ্র্যান্ড আল নুরি মসজিদ বোমায় ধ্বংস করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ওই মানুষদের অনুভূতিতে আঘাত হানেনি। ভারতের মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ হতে পারে কিন্তু ইরাকের গ্র্যান্ড আল নুরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য প্রতিবাদ হয়না।
ঘটনার পূর্বাপর বলছে, ভারতে কিছু হলে ‘তাদের’ যতটা অনুভূতি জাগে, অন্য দেশের বেলায় ততটা জাগে না। অথবা ‘তাদের’ অনুভূতি তখনই জাগ্রত হয়, যখন স্বার্থে টান পড়ে। মানবতার কারণে সত্যিই যদি ‘তাদের’ অনুভূতি জাগে, তাহলে চীন-মিয়ানমার-আমেরিকার বেলায় কোথায় থাকে ‘তাদের’ অনুভূতি! তবে এটাও ঠিক, স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তে দেশের মানুষ বিচলিত নয়। হাজার বছরের সম্প্রীতি এখনো ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। কিছু মানুষ সাম্প্রদায়িক হামলা করলেও কোটি কোটি মানুষ এখনো এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ধর্ম-বর্ণ মুছে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয় বাংলাদেশ। যার বীজ বপন হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার বাংলাদেশের মানুষ জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে ভারত। আমাদের যেমন ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদে হয়েছিলেন, তেমনি ১ হাজার ৬৬১ জন ভারতীয় সৈনিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। দুই দেশের মানুষের রক্তস্রোতে ১৬ ডিসেম্বরে এসেছিল বাংলাদেশের বিজয়।
দুই দেশের এই সম্পর্ক চিরস্থায়ী। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করেছিলেন ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরকাল অটুট থাকবে। বিশ্বের কোনো শক্তিই এটিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধু ভারত সফর করেছিলেন (যাত্রাবিরতিসহ) পাঁচবার, যা একটি দেশে বঙ্গবন্ধুর সর্বোচ্চসংখ্যক সফর ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর এই সম্পর্ক থমকে যায়। তবে ১৯৯১ সালে এরশাদ সরকারের পতন হলে দেশে আবার ফিরে আসে গণতন্ত্র। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও তিনবার বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু গঙ্গার পানিবণ্টন সমস্যার কোনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
তবে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পাঁচ মাসের মধ্যেই ওই সমস্যার সমাধান হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর হয়। কিন্তু ২০০১ সালের খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। কারণ ভারতের জুজুর ভয় দেখিয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা হয়েছিল। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে সাম্প্রদায়িক শক্তির ওপর নির্ভর করেছিল। তাই নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে মসজিদের আযান বন্ধ হয়ে যাবে, উলুধ্বনি বাজবে।
২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করলে দুই দেশের সম্পর্ক মূলধারায় ফিরে আসে। তখন থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত নির্ধারিত উন্নয়নের দিকে এগিয়ে চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারত সফর করেছিলেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে উন্নয়নের জন্য সহযোগিতা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ২০১৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ সফরে আসেন।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ওই সফরের এক মাসের মধ্যেই ১১১টি ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যুক্ত হয় এবং ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতীয় ভূখণ্ডে পরিণত হয়, যা বিগত ৬৮ বছরের মানবিক সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাপ্তি ছিল।
শেখ হাসিনা ১৯ আগস্ট ২০১৫ ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী শ্রীমতী সুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে ভারতে গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের এপ্রিলে এক রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন।
২০১৮ মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ওই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে, দুই প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত ‘বন্ধুত্বের পাইপলাইন’ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং দুটি রেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে চারটি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় সফর করেন ২০২২ সালে। ওই বছরের ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর সেই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়, আলোচনা হয় নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্পর্ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সহযোগিতা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার রোধ। ২০২৩ সালের ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা আবার ভারত যান জি টোয়েন্টি সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। এই সফরেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তার। সই হয় তিনটি সমঝোতা স্মারক।
চলতি মাসের ৮ থেকে ১০ জুন ভারত সফর গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতের পার্লামেন্ট নির্বাচনে জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া নরেন্দ্র মোদি শপথ অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এর মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ২১ জুন ফের ভারত সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসা শেখ হাসিনার এই মেয়াদে এটি ভারতে প্রথম আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় সফর। আর ভারতেও প্রধানমন্ত্রী পদে টানা তৃতীয়বারের মত শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।
বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব নিয়ে আগেই ষড়যন্ত্র হয়েছে, আগামীতেও হবে। কিন্তু সব চক্রান্ত পায়ে ঠেলে, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের বন্ধন যেমন এগিয়ে চলছে। তেমনি এই সম্পর্কগুলো এতটাই উচ্চতায় পৌঁছেছে যে, দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিশ্বের সামনে এখন রোল মডেল।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।