পলাশ আহসান
২০২৩ এর শেষের দিকে আমাদের জাতীয় নির্বাচনের আগে আগে একটা গবেষণা প্রতিবেদন বেশ আলোচিত হয়েছিল। রিউমর স্ক্যানার নামের একটা প্রতিষ্ঠান প্রকাশ করেছিল প্রতিবেদনটি। কিছুদিন ধরে রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপপ্রচার নিয়ে গবেষণা করে পরিচিত হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে সবচেয়ে বেশি ভুয়া সংবাদের শিকার হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে সেই ভুয়া খবর ছড়ানো হয়েছিল।
রিউমার স্ক্যানারের প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনেরে আগে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়ায়। যা মোট ভুল তথ্যের ২৩ শতাংশ। ২৪৮ রাজনৈতিক গুজবের ৪৩টি ছিল শেখ হাসিনার নামে। যা মোট ভুল তথ্যের ১৭ শতাংশ। এছাড়া, আ্ওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরেকে নিয়ে গুজব ছিল ১২টি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে নিয়ে ১০টি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে নিয়ে ৮টি এবং গণ অধিকার পরিষদ নেতা নুরুল হক নুরের বিষয়ে ৭টি তথ্য প্রচার হয়।
এবার আরেকরকম তথ্য দেই। সম্প্রতি সংঘবদ্ধভাবে অসত্য প্রচারের অভিযোগে বাংলাদেশের ৫০টি ফেসবুক আইডি ও ৯৮টি পেজ বন্ধ করেছে ফেসবুক৷ ফেসবুকের মূল কোম্পানি মেটা’র ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। সেখানে বলা হয় এই অসত্য প্রচারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাই এই অপপ্রচারের সঙ্গে যারা রয়েছে, তারা স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই চিহ্নিত হয়েছে এবং তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল সমন্বয়ক তন্ময় আহমেদের টুইটার অ্যাকাউন্টও রয়েছে৷
এনিয়ে তন্ময় আহমেদ গণমাধ্যমে বলেছেন, ওই অ্যাকাউন্ট কে চালান তা তিনি নিশ্চিত নন। এর পরেও মেটা ঢালাওভাবে যে অভিযোগ করেছে, সেটা সত্যি নয়৷ তার টুইটার অ্যাকাউন্টটি চালু আছে৷ এনিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি জানায় তাদের কাছে এনিয়ে কোন তথ্য নেই। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটও জানায় তাদের কাছেও কোন তথ্য নেই। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোন অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হলে স্পষ্ট অভিযোগ দরকার হয়। সেই অভিযোগ হয় কোন ব্যক্তিকে করে না হয় রাষ্ট্র অথবা সংগঠন করে। কিন্তু এরই মধ্যে বিএনপির মিডিয়া সেলের আহবায়ক জহির উদ্দিন স্বপন জানিয়েছেন তারা মেটার কাছে কোনো অভিযোগ করেননি।
সামিাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষ স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কোন অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে পারবেন না তা নয়। সম্প্রতি বন্ধ হওয়া পেজগুলো বন্ধের ব্যাপারে মেটা যে বিবৃতি দিয়েছে তাতেও মনে হয়েছে তারা নিজেরাই কাজটি করেছে। ধরে নিচ্ছি, মেটা যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটা সত্য। তাই শুরুতে এমন উদ্যোগে আমি স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ আমরা এখন জানতে পারলাম যে, মেটা নিজোরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্ত পরেক্ষণেই বলছি, তাদের পর্যবেক্ষণ প্রশ্ন বিদ্ধ। কারণ মাত্র তিন মাস আগের আলোচিত গবেষণা প্রতিবেদনটি তাদের চোখেই পড়েনি। অথচ গবেষণা করে সেখানে কারা গুজবের শিকার হচ্ছে, সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছিল।
লেখার এ পর্যন্ত পরস্পর বিরোধী দু’টি গল্প বললাম। কারণ আর কিছু নয় । আসলে পরিস্কার করে বলতে চাইলাম, আমাদের সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের বর্তমান চলার যে ধরণ, তাতে কোন ভাবেই একে নিরপেক্ষ বলার কোন সুযোগ নেই। এদের কোন কিছু সুষম নয়। তাদের সত্য তাদের মত। সেই সত্য ভিউ, লাইক আর শেয়ার নির্ভর। আর যদি বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসাবে বলতে চাই, তাহলে আরেক ধাপ এগিয়ে বলতে হবে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ভিত্তিক যত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে এর সবই প্রগতি বিরোধী। এখানে কুসংস্কার এবং মিথ্যা দ্রুত ছড়ায়। যে বা যারা দ্রুত ছড়ায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গোটা কাঠামো তার দিকে থাকে। মানুষের শুভ হয় এমন বিষয় যে ছড়ায় না, তা বলা যাবে না। কিন্তু এর গতি যদি কচ্ছপের হয় তাহলে খারপ ছড়ানোর গতি খরগোসের মত।
গত ২০ বছর ধরে একটু একটু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সমাজ জীবনে জেঁকে বসেছে। এখন শহর থেকে দূর গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছেছে ইন্টারনেট। সমাজ জীবনের সার্বিক যোগাযোগে ইতিবাচক বদল এসেছে সন্দেহ নেই। জীবন যাত্রা অনেক সহজ হয়েছে। অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাবও পড়েছে। কিন্তু যোগাযোগের পথ খোলা থাকায় নেতিবাচক পথ্ও খুলেছে বহু। রাষ্ট্র বা সরকার ইন্টারনেটের ইতিবাচক পথে মানুষকে হাঁটতে সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি কোন সহায়তা ছাড়াই খারাপ মানুষ তার উদ্দেশ্য পূরণের কৌশল বের করে ফেলেছে সহজেই।
আজ এক ক্লিকেই মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া যায়। কোন কাজ না করেও মুহূর্তেই আকাশ ছোঁয়া সুনাম যোগ করা যায় নিজের নামের পাশে। আর সারাজীবন ভালো কাজ করেও অনেকে সাফল্যর তলানিতে থাকেন। ভাল-মন্দের পার্থক্য আজ অনেকটা ভিউ আর লাইক নির্ভর। আর সবচেয়ে বড় ক্ষতির বিষয়টি হচ্ছে অপপ্রচার। একেবারে দুর্যোগের মত এক লাইনের অপপ্রচারে মুহূর্তে একজন সৎ মানুষ নেতিবাচক মানুষে পরিণত হতে পারেন। নানা চেষ্টায় তিনি হয়তো তার কথা বলতে পারেন, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। অপপ্রচারে ধসে যাওয়ার পর আর দাঁড়াতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যা আমাদের চারপাশে বহু।
এই অপপ্রচারের কাজটি হয় ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সামোজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই নেতিবাচক বিষয়টি আমাদের সরকার যন্ত্র বুঝেছে বছর দশেক হলো। আমি বলবো এটি আরো আগে হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, অবশেষে এব্যপারে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রযন্ত্র। সম্প্রতি খোদ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন নিরাপদ সাইবার স্পেস, সাইবার অপরাধ দমন ও অপপ্রচার ঠেকাতে একটি আলাদা ‘সাইবার পুলিশ ইউনিট’ গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার। এখানে তিনি উল্লেখ করেছেন কীভাবে, কারা, কেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার করছে। ২০২৩ এর জানুয়ারি মাসে পুলিশের কাজ নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কিছু দাবি তুলে ধরেছিলেন উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা। সেখানেও প্রথম দাবিটাই ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটকেন্দ্রিক যেকোনো অপরাধ দমনে ‘পুলিশ সাইবার ব্যুরো’ গঠন করা।
কাগজ পত্রে দেখা যায়, পুলিশ কিন্ত সাইবার অপরাধ দমনে কাজ শুরু করেছে আরও আগে। এছাড়া যেকোন অপরাধের তদন্তে পুলিশ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে সেই শুরু থেকেই। এরই মধ্যে জেলায় জেলায় পুলিশের মধ্যেই ছোট ছোট ইউনিটও গঠন হয়েছে । পুলিশের বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে সাইবারর অপরাধ ক্রমশ বাড়ছে। জঙ্গিবাদ, আর্থিক অপরাধ, প্রতারণা, নারীদের সম্মানহানি, সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়িয়ে দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়ার ক্ষেত্রেও সাইবার স্পেস ব্যবহার হচ্ছে। তাই অনিয়ন্ত্রিত ইন্টানেনেটর ব্যবহারে বর্ধিত সাইবার অপরাধ দমনে একেবারে পুলিশের আলাদা বিভাগ গঠনের বিকল্প দেখছে না খোদ পুলিশ বাহিনীও।
অবস্থাদৃষ্টে আমি নিজেও দেখছি না। কিন্ত পাশাপাশি এও বলতে চাই যে শুধু পুলিশিং করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যাচার প্রতারণা এবং অপপ্রচার ঠেকানো যাবে না। কারণ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যত অপরাধ হয় এর বেশিরভাগই ফেক আইডি বা ভূয়া পরিচয় ব্যবহার করে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এর জন্যে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ লাগবে। সেখানে পরস্কিার নিয়ম থাকা দরকার যে বাংলাদেশের কাউকে তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে দিতে হলে, তারা পরিচয় নিশ্চিত করতে হবে। এই নিয়ম তৈরীতে আইন দরকার। যেটা পুলিশের কাজ নয়।
এর পর দরকার সচেতনতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেক আইডি খোলা যে অপরাধ এবং এর জন্যে যে শান্তি হতে পারে সেই বার্তাটি থাকা দরকার একজন নতুন ব্যবহারকারীর কাছে । পাশাপাশি তার জানা দরকার কোন সংবাদ, ছবি, ভিডিও, অডিও প্রকাশ হলে কী ক্ষতি পারে তার রাষ্ট্র সমাজ এবং ব্যক্তি জীবনে। একই সঙ্গে সবার জানা দরকার কোন বিষয়ে তিনি শেয়ার কিংবা লাইক দিচ্ছেন তাতে তার বা তার চারপাশের কী উন্নতী। গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা বলে একটা বিষয় এখন সারাবিশ্বে দরকারি হয়ে উঠেছে। সেই বিষয়ে অবশ্য সেই সব দেশের গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা সরকারকে সহায়তা করছে। আমাদের দেশে এখনও ওই অর্থে গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা শুরুই হয়নি। কিন্তু এখনই শুরু করা দরকার। আমরা আসলে সাইবার জীবনের বাইরে যেতে পারবো না। এর ইতিবাচক ফল যেমন সবাই মিলেই ভোগ করছি, নেতিবাচক দিকটি ঠেকাতে হলে সবাই মিলেই প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের কেউ হাতে ধরে সাইবার নিরাপত্তা দেবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।