যে কারণে এসএসসিতে ছাত্রীরা এগিয়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সবখানেই ছাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বড় অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে মাধ্যমিক স্তরে। এখানে প্রায় প্রতিবারই নিজেদের গড়া রেকর্ড ভাঙছে ছাত্রীরা। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়েছে গত ১২ মে। তাতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুই সূচকেই ছেলেদের তুলনায় বেশি সাফল্য দেখিয়েছে মেয়েরা।

নারী শিক্ষায় এ অগ্রগতি স্বস্তির হলেও দিনকে দিন ছাত্রদের পিছিয়ে পড়া এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মাথাব্যথার কারণ।গত ১২ মে গণভবনে মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ছাত্রদের পিছিয়ে পড়ার কারণ খুঁজতে বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ক্রমাগত ছেলেদের সংখ্যা কমার কারণ জানতে পদক্ষেপ নেওয়ারও নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর এমন কথার পর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মেয়েদের এমন সফলতার পেছনে বাল্যবিবাহ রোধ কর্মসূচি, উপবৃত্তি আর মনোযোগ- মূলত এই তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দেখছেন অমনোযোগিতা, পরিবারের আর্থিক অস্বচ্ছলতা এবং কিশোর গ্যাং-এ জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাকে।

নয়টি শিক্ষাবোর্ডের অধীনে এবার এসএসসি, দাখিল, এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ১৩ হাজার ৫৯৭ জন। তাদের মধ্যে পাস করে ১৬ লাখ ৭২ হাজার ১৫৩ জন। পাস করা ছাত্রের সংখ্যা ৮ লাখ ৬ হাজার ৫৫৩ আর ছাত্রীর সংখ্যা ৮ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০। হিসাব অনুযায়ী পাস করা ছাত্রীর সংখ্যা বেশি ৫৯ হাজার ৪৭ জন। শতকরা হিসাবে ছাত্রদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৫৭ শতাংশ আর ছাত্রীদের ৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। অর্থাৎ ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের পাসের হার প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। জিপিএ-৫ অর্জনের দিকেও বেশ এগিয়ে ছাত্রীরা। এ বছর এসএসসিতে সব বোর্ড মিলিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। তাদের মধ্যে মেয়ে ৯৮ হাজার ৭৭৬ এবং ছেলে ৮৩ হাজার ৩৫৩ জন। এখানেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ১৫ হাজার ৪২৩ জন বেশি। দাখিল পরীক্ষাতেও ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা এগিয়ে। সেখানে ছাত্র ও ছাত্রীদের পাসের হার যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এসএসসি (ভোকেশনাল) ও দাখিল (ভোকেশনাল) পরীক্ষাতেও এগিয়ে আছে ছাত্রীরা। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষায় ৭৯ দশমিক ১৯ শতাংশ ছাত্র উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ৮৮ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ ছাত্রী পাস করেছে।

পরীক্ষার ফলে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এগিয়ে থাকার কারণ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ব্যক্তিসত্ত্বার কথা বলছে তেমনই বলছে শৃঙ্খলার কথাও। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বলেন, “সাইকোলজিক্যাল দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় অনেক শান্ত এবং অধ্যবসায়ী। ফলে রাষ্ট্র যখন মেয়েদের সুযোগ করে দিয়েছে, সেটা তারা সর্বোপরি কাজে লাগাতে পারছে।”

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম বলেন, “গত দুই দশকে শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ যেমন উপবৃত্তি মেয়েদের জন্য একটা বিশেষ বলয় হিসেবে কাজে লেগেছে। তাছাড়া মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ রোধের কর্মসূচিও এখানে অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে।”

মেয়েদের এগিয়ে নিতে যেসব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তারাও তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করেন এই অধ্যাপক।এখন ভারসাম্য আনতে কাজ করা প্রয়োজন মন্তব্য করে অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, “যুগের পরিবর্তনে ছেলেরা নতুন কোনও সমস্যার মুখে পড়ছে কিনা, তা নিয়ে কাজ করার সময় এসেছে। এসব চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলেই একমাত্র ভারসাম্য আনা সম্ভব হবে।”

পাসের হার ও ভালো ফলাফলের ক্ষেত্রে ছাত্রীরা যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি ছাত্রদের পিছিয়ে পড়ার চিত্র দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরেই। এবার এসএসসির ফল ঘোষণার দিন প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মেয়েরা বাড়লে খুশি হই। কিন্তু ছেলে কেন কমল, এটা জানতে হবে। সমান সমান হলে ভালো। যার যার বোর্ডে খোঁজ নেবেন। কিশোর গ্যাং কালচার দেখতে পাচ্ছি। কাজেই এটা খতিয়ে দেখতে হবে। বিবিএসকে বলতে পারি জরিপের সময় এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করতে।”

বিএএফ শাহীন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক নাজনীন খানম বলেন, “আমার পর্যবেক্ষণ বলে, ছেলেরা মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও কোনও পরীক্ষা নেওয়া হলে মেয়েরা ভালো ফলাফল করে। এর কারণ শৃঙ্খলার অভাব। মোবাইল, টিভি ও ভিডিও গেম ইত্যাদিতে অতিরিক্ত সময় খরচ করাও এর কারণ।” গত কয়েক বছরে শহর থেকে গ্রাম, সবখানে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থানও ছেলেদের লেখাপড়ায় পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলেও মনে করছেন এই শিক্ষক।

আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকারে বলেন, “কয়েক বছর ধরেই ছাত্রীরা সুনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে আছে। এটা নিয়ে ভাবা উচিত।” তার মতে, “মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও অমনোযোগী হওয়ায় ছাত্ররা ভালো ফলাফলে পিছিয়ে পড়ছে। একাডেমিক ক্ষেত্রে ছাত্রীরা সবসময় ভালো। সবমিলিয়ে একটা প্রভাব পড়েছে চূড়ান্ত ফলে।”

এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, “শিক্ষার্থীদের সমানভাবে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মোতাবেক আমরা এরই মধ্যে কাজ করছি। প্রয়োজনে শিক্ষা নীতিতেও আমরা পরিবর্তন আনব। ছাত্রদের কীভাবে উৎসাহিত করা যায় সেটি দেখব।”

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি