পলাশ আহসান
আবারও সামনে আসলো্ সেই ভূইফোড় ওয়েব পোর্টাল। নামটা ইচ্ছে করেই বলছি না। গত ৩/৪ দিন ধরে আমাদের দেশের নামী দামী সংবাদপত্রে সেই ওয়েব পোর্টালের নাম দফায় দফায় ছাপা হয়েছে। আরও হবে নিশ্চয়ই। আমি আরকেবার নাম না লিখে তাদের বিজ্ঞপন দেয়া থেকে দূরে থাকলাম। কারো প্রতি ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দ নয়। যে প্রতিষ্ঠানটিন নাম বলছি, তারা বার বার আমাদের প্রচলিত মিডিয়াগুলোকে প্রভাববিত করছে। আমি আসলে প্রভাবিত না হয়ে তাদের প্রভাব বিস্তারের কারণটা বলতে চাই।
পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন কোন প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি। না বুঝলেও ক্ষতি নেই। তাদের কাজের কথা শুনুন। গত ১৪ মে তারা একটি খবর প্রকাশ করেছে সেখানে বলা হয়েছে, আবারও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ভারতীয় হ্যাকাররা। তাদের খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্তত তিনজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাকি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছে।
সূত্র হিসাবে নাম প্রকাশে “অনিচ্ছুক” কৌশলটি বেশ পুরোনো। বিশেষ করে আজকের এই প্রযুক্তি যজ্ঞের যুগে নাম প্রকাশ না করায় অনিচ্ছুক থেকে খুব লাভ হয় না। সবাই সব জেনে যায়। বিশেষ করে কেন সূত্রের নাম প্রকাশ করা যাবে না, সেটা তো বটেই। যেমন খুব সাধারণ ক্ষেত্র বা খুব সেনসেটিভ ক্ষেত্রে যখন নাম প্রকাশ করা হয় না, তখন সবাই বুঝতে পারে কেন তথ্যটি চাপিয়ে দেয়া হলো। অর্থাৎ তথ্যটির সূত্র নাম ‘প্রকাশে অনিচ্ছুক’।
এরই মধ্যে রিজার্ভ চুরির খবর সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের মুখপাত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, বাংলাদেশের নতুন করে রিজার্ভ চুরি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদটি সত্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের থ্রি স্টেপ ভেরিফিকেশন নীতি রয়েছে। লেনদেনের বিষয়গুলো নিয়মিত সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু কাজটি করতে হলো বাংলাদেশ ব্যাংককে।
আমাদের এই অসহায় আত্মসমর্পণে আমি হতাশ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে একটি অখ্যাত অজ্ঞাত ওয়েব পোর্টালের ভিত্তিহীন তথ্যে কেন এত উদ্বিগ্ন হতে হয়? এদের ওয়েবসাইটে গিয়ে, কে এটি সম্পাদনা করেন, তার নাম পাওয়া যায় না। বলা হয় শুধু ভারতের আসাম থেকে সংবাদমাধ্যমটির কার্যক্রম চলে। আর সেখানে গুজব আর বিতর্কিত ইস্যু ছাড়া এতে কিছুই চোখে পড়ে না। আজকের দিনে শুধু জায়গার নাম লিখলেই প্রমাণ হয় না এটি ওই যায়গা থেকে প্রকাশ হয়। আর সেটা প্রমাণ বা অপ্রমান করার দরকার হয়, তখনই যখন তার কাজ শুধু মানুষকে তথ্য দেয়া নয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভুল তথ্য দেয়া।
এটি কোত্থেকে প্রকাশ হয় তা বের করতে গেলে যে প্রযুক্তি দরকার হয় তা আমজনতার কাছে থাকার কথা নয়। তাই আমরা নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি ওয়েব পোর্টালটি নিজেদের পরিচয় লুকাচ্ছে। যারা নিজেদের পরিচয় লুকিকে অনলাইনে তথ্য ছড়ান, তাদের সেই কাজটিকে আর যাই বলি সাংবাদিকতা বলার কোন কারণ নেই। তাদের বড়জোর সংবাদের ক্লু বলা যেতে পারে। যেটা কমপক্ষে ৩টি সূত্রে নিশ্চিত করে তার পর প্রকাশ্য গণমাধ্যমে আনতে হবে। অথচ সেই ক্লুর সূত্র ধরে এরইমধ্যে বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকাগুলো নানা ভাবে খবর প্রচার করেছে। যদিও সেসব খবরে নানাভাবে তথ্যের সন্দেহের কথা বলা আছে। কিন্তু প্রচার তো হলো।
আমার মনে হয় এই প্রচারটাই তাদের লক্ষ্য। নিজেদের পোর্টালের এনগেজমেন্ট বাড়ানোও উদ্দেশ্য হতে পারে। কিন্তু সময় ধরে আশের পাশের আরও নানান ঘটনা মিলিয়ে যখন অপপ্রচার হয় তখনতো এটাকে পরিকল্পিত প্রপাগাণ্ডা বলতেই হয়। আজকে যে ওয়েব পোর্টারের কথা বলছি তারাও জানে এরকম একটি তথ্য প্রচার হলেই না বুঝে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারাও এসমন সময় বেছে নিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ নিয়ে গুজব ছড়ানোর যখন অন্য একটা ইস্যুতে ব্যাংকে সাংবাদিকদের ঢোকার শর্তারোপ করা হয়েছে। যেন ওত পেতে ছিল।
আমার মনে হয় এই গুজবের বিষয়গুলো বুঝি না শুধু আমরা সাংবাদিকরাই। কিন্তু বোঝা উচিত ছিল। কারণ এই পোর্টালে কিছু দিন আগে একজন ব্যক্তি বাংলাদেশ নিয়ে আরও নানা প্রপাগাণ্ডা করেছে। তখনও প্রচলিত গণমাধ্যমের কেউ কেউ নানা কৌশলে সেসব গুজব প্রচার করেছে। যেমন সব শেষ সংসদ নির্বাচনের আগে আগে মার্কিন স্যাংশন, জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা, বিমান বাহিনী প্রধানসহ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা স্যাংশন সহ নানা গুজব ছড়াচ্ছিল। দিন তারিখ ধরে নানা বিপদের কথা বলছিল। দিন তারিখ মেলা তো দূরের কথা সেসব বিপদই আসেনি। কিন্তু নির্বাচনের আগে মানুষের মনে নানা ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এরই মধ্যে যার প্রতিটিই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষত কী সেরেছে?
সেসব গুজবের লাইন ধরে হয়তো লেখা যেতো । ইচ্ছে করেই লিখলাম না। বলতে পারেন গুজবটা আরেক দফা ছড়ালাম না। কিন্তু যে ওয়েব পোর্টালটির নাম লিখলাম না তারা তো এরই মধ্য একটা উদাহরণ তৈরি হয়ে থাকলো আমাদের গণমাধ্যমের ইতিহাসে। এরকম যে কেউই করতে পারে। ঢাকায় বসে গুজব ছড়িয়ে যে কেউ বলতে পারে এটা পাপুয়া নিউ গিনির ওয়েব পোর্টাল। বলতে পারিই বা বলি কেন? আসলে তো কাজটা অনেকেই করে। তাই গুজব কোথা থেকে ছড়ানো হয়েছে সেটা এখন আর দেখার বিষয় নয়। দেখা দরকার কখন ছড়াচ্ছে কেন ছড়াচ্ছে। এতে কার লাভ কার ক্ষতি।
তাছাড়া সবচেয়ে যে বিষয়টিতে সাংবাদিকদের গুরুত্ব দেয়া দরকার সেটা হচ্ছে, যে গুজবটা আমর সামনে আসলো এটা শুধুই গুজব না খবর তৈরির জন্যে গুজব? গুজবের সময় আশেপাশের ঘটনা মেলালে নিশ্চয়ই একজন সাংবাদিক সেটা বুঝতে পারবেন্। কারণ এত দিনে নিশ্চয়ই আমরা জেনে গেছি, কোন পথে সাংবাদিকদের আর কোন পথে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করা হয়। কারা করে? আজকাল কোন তথ্যটি গুজব আার কোন তথ্যটি তথ্য তা চিহ্নিত করার পেশাদার পদ্ধতি বাজারে এসছে। সেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা খুব সহজও। আমার মনে হয় আমাদের গণমাধ্যমের উচিত, খবর খোঁজার আগে গুজব ধরার যন্ত্রে মনোযোগ দেয়া।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।