পলাশ আহসান
এবারের একুশে পদক ঘোষণার পর টানা ২৪ ঘণ্টা দুইজনকে নিয়ে ধন্দে ছিলাম। ঠিক চিনতে পারছিলাম না। গুগল মামা বা উইকি ভাই কেউ কোন তথ্য দিতে পারছিল না। শক্তপোক্ত কয়েকজন রিপোর্টারও ব্যর্থ হলেন। অবশেষে বাঁচালো বাংলা ট্রিবিউন এবং চট্টগ্রাম প্রতিদিন। পরে অন্যান্য গণমাধ্যমে এসছে এবং আসছে। আমি আসলে এবার সমাজ সেবায় একুশে পদক প্রাপ্ত রফিক আহমেদ এবং জিয়াউল হক সম্পর্কে না জানার অন্ধকারে ছিলাম। বাকি ১৯জনকে চিনি। দুই একজন ছাড়া এই চেনা ব্যক্তিগত নয়। অর্থাৎ যিনি যে খাতে স্বীকৃতি পেয়েছেন সেই কাজের সাফল্যের কারণেই চেনা।
একটি দেরিতে হলেও সমাজ সেবায় দুজনের স্বীকৃতির কথা জেনে মন ভাল হয়ে গেছে। সেই চাঁপাইনবাবগঞ্জের দূর গ্রামে খুব কম পূঁজির ব্যবসা করেন জিয়াউল হক। সেই আয়ের টাকা বাঁচিয়ে একটি পাঠাগার গড়েছেন তিনি। পাশাপাশি বই কিনতে না পারা শিক্ষার্থীদেরও সহায়তা করছেন ভদ্রলোক। আমাদের আজকের এই আত্মকেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এমন অবদানের কথা ভাবাই যায় না। অন্যজন ব্যবসায়ী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত ছেলে। তিনি শুরু করেছেন তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে। এর পর বহু মানুষের কাজের যোগাড় করেছেন। সংগঠন বড় করেছেন। সব শেষ বিলুপ্ত প্রাণী সংরক্ষণের কাজ করছেন।
এই দুই সমাজসেবকের বর্তমান বয়স বেশ বেশি। কাজ করছেন অনেক দিন। কিন্তু আমারই চিনতে সময় লাগলো। আচ্ছা আমার কথা না হয় বাদ দিলাম, তারা পরিমাণ কাজ করেছেনে তাতে গুগলের অচেনা থাকার কথা নয়। অন্তত আজকের এই প্রোপাগান্ডান বিশ্বে। হ্যাঁ প্রচারের বাইরে থাকতে পারেন যদি তারা প্রচার বিমুখ হন। অর্থাৎ একথা প্রমাণিত যে তারা আসলে স্বীকৃতির জন্যে কাজ করেননি। কাজের জন্যে কাজ করেছেন। পরে কেউ একজন আজকের এই স্বীকৃতি দেয়ার জন্যে তাঁদের খুঁজে বের করেছে। স্বীকৃতির জন্যে তারা তদবির করেননি। এমন মানুষকে পুরস্কার দেয়ার মধ্যেও গৌরব আছে।
পুরস্কারের জন্যে তদবির! প্রসঙ্গটি এসেই গেলো। এই গতবছরই এনিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম একটা গণমাধ্যমের ওয়েব পোর্টালে। এর আগে তারা আমার লেখা আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করলেও এই লেখাটি করলো না। আমাকে তারা জানালো, প্রতিষ্ঠানের প্রধান একুশে পদকের জন্যে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পাননি। এখন এরকম লেখা ছাপলে যারা পুরস্কার দেন তারা ক্ষুব্ধ হবেন। কিন্তু যেটা বললেন না সেটা হচ্ছে আগামী বছরের সম্ভাবনাটা শুধু শুধু নষ্ট করা কেন? আমি বুঝলাম। যে কারণে কোন উচ্চবাচ্য না করে লেখাটি আরেকটি নামী পত্রিকায় দিয়ে দিলাম। তারা খুব আগ্রহ নিয়েই ছেপেছিল।
এবার একুশে পদক ঘোষণার পর খুব আগ্রহ নিয়ে দিখছিলাম সেই ভদ্রলোকের নাম তালিকায় আছে কী না। দেখলাম নেই। কিন্তু অন্য যাদের নাম দেখলাম সত্যিই আনন্দিত হলাম। কারণ তাৎক্ষণিকভাবে দু’টি সত্য আমার মাথায় টোকা দিলো। একটি হচ্ছে যিনি যে খাতে এবার পদক পেয়েছেন তিনি সেই খাতের পরিচিত মুখ। সেই খাতে তাঁর নিবিড় অনুশীলন অবদানের পর্যায়ে পড়ে। নিজেকে চেনানোর জন্যে তাঁকে তদবির করতে হয়নি। অতএব এবার সত্যিকার অর্থেই গুণীরা কদর পেয়েছেন। আর দ্বিতীয় টোকাটি হচ্ছে, তদবিরবাজীর কারণে এখন থেকে গুণীদের পয়েন্ট কাটা শুরু হয়েছে। কারণ যে ভদ্রলোক, কর্তৃপক্ষের মনোযোগ হারানোর ভয় পাচ্ছিলেন তিনি কিন্তু তাঁর খাতের আলোচিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু তিনি নিজের গুণপনার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তদবিরের আশ্রয় নিয়েছেন।
এখানে বলতেই হবে যারা এবার একুশে পদক দিয়েছেন, বিচার বিবেচনা করেই দিয়েছেন। একেকটি নাম যেন গুণপনার মূর্ত প্রতীক। এম এ আলমগীর, রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, লুৎফর রহমান রিটন, শিমুল মোস্তফা, ডলি জহুর, শিবলী মোহাম্মদ কে কার খাতে কম প্রতিষ্ঠিত? সারাদেশের মানুষ তাদের চেনেন। তাদের স্বীকৃতি নিয়ে আম জনতার কাছে কোন প্রশ্ন নেই। বরং কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে এতদিন তারা কেন স্বীকৃতির বাইরে থাকলেন? কেউ কেউ আরেকটু বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছেন এবার কেউ রীতিমত আবিস্কার হয়েছেন? পূর্ব দীগন্তে সূর্য উঠেছে গানটি বছরের পর বছর মানুষের মুখে ফিরছে। কিন্তু ক’জন জানেন এর শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষের কথা? কিন্তু এবার তিনি আলোয় এসেছেন। পদক কর্তৃপক্ষকে অভিবাদন না জানিয়ে উপায় কী?
পদক পেয়েছেন আমাদের কাওসার ভাই। আমাদের বলতে টেলিভিশন এবং মঞ্চ কর্মীদের। বীর মুক্তিযোদ্ধা, অসংখ্য তথ্যচিত্রের নির্মাতা এবং গুণী অভিনেতা কাওসার চৌধুরীকে আমাদের মধ্যে দেখে কেউ বুঝবে না তিনি এমন মহীরুহ। সারাক্ষণ হা হা হো্ হো এর মধ্যেই থাকেন। ১২বছর আগে একটি টেলিভিশনে তাঁর সঙ্গে চাকরি করেছিলাম। তখনও তাঁর মধ্যে আজকের সব গুণ পুরোমাত্রায় ছিল। ধুন্ধুমার আড্ডা হয়েছে দিনের পর দিন। কিন্তু কখনো তাঁর কাছে পুরস্কার না পাওয়ার আক্ষেপ শুনিনি। তবে আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে কীভাবে ভাল কাজ করা যায় সেসব অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন বিস্তর। সব শেষ একজন সিনিয়র টেলিভিশন কর্মীকে খুঁজে বের করেছিলাম কাওসার ভাই আর আমি। একজন সহকর্মী কোথায়? সেই আকুতি নিয়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা শুরু করেন। সেই আবেগের সম্মানে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম আমিও। কারণ আজকাল নেহায়েত ভাল মানুষ না হলে, এসব কাজ মানেই সময় নষ্ট বলে মনে করেন অনেকেই।
সব মিলিয়ে আমরা বলতে পারি, এবার একুশে পদক দেয়ার আগে মানুষের মানবিক অনুশীলনের বিষয়গুলোও আমলে আনা হয়েছে। কারণ একজন মানুষ গুণী হলেই তার আচরণ মানবিক হবে এমন নয়। এখানে অনেক উদাহরণ দেয়া যায় হয়তো। কিন্তু এই লেখায় কাউকে বিব্রত করতে চাই না। মোদ্দা কথা ভাল এবং গুণী মানুষেরা এবার একুশে পদকের তালিকায় এসেছেন। অনেকে ভাবতে পারেন তাহলে আগে যারা পেয়েছেন তারা কী গুণী ছিলেন না? নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু ২১ জনের তালিকায় এমন একজনের নাম থাকতো যিনি পুরো প্রক্রিয়াটাই প্রশ্নবিদ্ধ করতেন। কখনও কখনও সেই নাম প্রত্যাহারের দাবি উঠতো জোরে-শোরে। এবার সেরকম নাম আমি অন্তত দেখছি না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।