নীলফামারী জেলায় অনেকটাই প্রভাব ছিল জাতীয় পাটির। সে প্রভাবে এরশানের পতনের পরও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জেলার চারটি আসনের মধ্যে তিনটিই ছিল জাতীয় পাটির ঘরে। এরপর ২০০৮ সালে ২টি, ২০১৪ সালে ১টি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ২টি আসনে নির্বাচিত হন লাঙ্গলের প্রার্থী।
চলতি নির্বাচনে সে সংখ্যা পৌঁচেছে শূন্যের কোঠায়। এবার চারটি আসনেই লাঙ্গলের প্রার্থীর হয়েছে ভরাডুবি। এবার আসন চারটি মধ্যে নীলফামারী এক আসনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে লাঙ্গল দ্বিতীয় স্থানে এবং ২,৩ ৪ আসনে রয়েছে তৃতীয় স্থানে।
আসন চারটির মধ্যে নীলফামারী-১ (ডোমার-ডিমলা) আসনে আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রার্থী আফতাব উদ্দিন সরকার তৃতীয় বারের ন্যায় নির্বাচিত হন। তিনি এক লাখ ১৯ হাজার ৯০২ ভোট পেয়েছেন। নিকটতম লাঙ্গলের তছলিম উদ্দিন পেয়েছেন ২৪ হাজার ৬৬২ ভোট। আসনটিতে ১৯৯৬ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন লাঙ্গলের এনকে আলম চৌধুরী, ২০০৮ সালে জাফর ইকবার সিদ্দিকী (মহাজোট)। এবারের নির্বাচনে সাত প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে লাঙ্গল দ্বিতীয় স্থানে থাকলে ভোটের ব্যবধান অনেক।
নীলফামারী-২ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান নূর নৌকা প্রতীকে এক লাখ ১৯ হাজার ৩৩৯ ভোট পেয়ে পঞ্চমবার নির্বাচিত হন। এ আসনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (ট্রাক) পেয়েছেন ১৫ হাজার ৬৮৪ ভোট । আর জাতীয় পার্টির মো. শাহজাহান আলী চৌধুরী লাঙ্গল প্রথীকে পেয়েছেন তিন হাজার ৮৪৩ ভোট। এ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন চারজন। ১৯৯৬ সালের প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ নির্বাচনে এ আসনে লাঙ্গল প্রতীকের আহসান আহমেদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদ্দাম হোসেন পাভেল কাঁচি প্রতীকে ৩৯হাজার ৩২১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মার্জিয়া সুলতানা ঈগল প্রতীকে পেয়েছেন ২৫ হাজার ২০৫ ভোট। আওয়ামী লীগ আসনটি জাতীয় পাটির জন্য ছেড়ে দিলেও লাঙ্গলের প্রার্থী সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল ১০ হাজার ২২৮ ভোট পেয়ে রয়েছেন তৃতীয় স্থানে। এ আসনে আ.লীগের স্বতন্ত্র চারজন প্রার্থীসহ ৯জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন।
আসটি ২০০৮ সালে মহাজোটের হয়ে লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচিত হয়েছিলেন কাজী ফারুক কাদের ও ২০১৮ সালে রানা মোহাম্মদ সোহেল।
নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সিদ্দিকুল আলম কাঁচি প্রতীকে ৬৯হাজার ৯১৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মোখছেদুল মোমিন ট্রাক প্রতীকে পান ৪৫ হাজার ৩০১ ভোট। আসনটি জাতীয় পাটির জন্য আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিলেও সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান লাঙ্গল প্রতীকে ৪১ হাজার ৩১৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন। বিজয়ী সিদ্দিকুল আলম জেলা জাতীয় পাটির সহসভাপতি ছিলেন। নির্বাচন চলাকালে তাঁকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। অপরদিকে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মোখছেদুল মোমিন সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
এ আসনে ১৯৯৬ সালে লাঙ্গল প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন মুহাম্মদ আসাদুর রহমান, ২০১৪ সালে শওকত চৌধুরী এবং ২০১৮ সালে আহসান আদেলুর রহমান।
উল্লেখ্য, এবারের নির্বাচনে নীলফামারী-৩ ও ৪ আসন আওয়ামী লীগ ছাড় দেয় জাতীয় পাটিকে। কিন্তু ওই দুই আসনেই জাতীয় পার্টির প্রার্থী রয়েছেন তৃতীয় অবস্থানে।
জেলার চারটি আসনেই জাতীয় পাটির ভরাডুবির বিষয়ে স্থানীয় নেতা কর্মীরা বলছেন, এসব আসন থেকে এর আগে যাঁরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁরা দলীয় নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করেন নি। এছাড়া নির্বাচিত হয়ার পর এলাকায় না আসা, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা না থাকায় সাধারণ ভোটাররা মুখ ফিরে নিয়েছেন। সর্বোপরি দলটি দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকার কারণে গৃহপালিত দলের উপাধি পাওয়ায় জনগণ এবার তাদের প্রত্যাখ্যান করেছ।
এবিষয়ে জেলা জাতীয় পার্টির প্রচার সম্পাদক আব্দুল হান্নান বলেন, ‘জাতীয় পার্টি দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার কারণে অনেকে মনে করেন জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের গৃহপালিত দল। যাঁরা সংসদ সদস্য ছিলেন, তাঁরা নেতা-কর্মীদের কম মুল্যায়ন করেছেন, এলাকায় কম এসেছেন এবং ডোমার-ডিমলায় দলীয় কোন্দল আমাদের ফল বিপর্যয়ের মূল কারণ’।
এ বিষয়ে জেলা জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ পারভেজ বলেন, ‘এটাকে ভরাডুবি বলা যাবে না। কারণ আমাদের প্রার্থীরা সম্মানজনক ভোট পেয়েছেন। আমাদের দলীয় আসনে আমাদের একাধিক প্রার্থী ছিলেন, এছাড়া আমাদের জেলা জাতীয় পার্টির সহসভাপতি সিদ্দিকুল আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ কারণে আমাদের সফলতা, ব্যর্থতা দুটোই আছে।’
এ বিষয়ে কথা বলতে নীলফামারী-৩ জলঢাকা আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেলের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি কেটে দেন। নীলফামারী-৪ সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ আসনের প্রার্থী সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমানের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ফোন ধরেননি।
তবে নীলফামারী-১ আসনের লাঙ্গলের প্রার্থী তছলিম উদ্দিন বলেন,‘আমরা সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী। আমার আসনে নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর লোকজন লাঙ্গলের নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাধারণ ভোটারদের মাঝে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন। ফলে ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে আসতে নিরুতসাহিত হন’। এসময় বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট ও গণনায় সংখ্যা পরিবর্তন করে ভোট কারচুপির অভিযোগ করেন তিনি।