ড. সন্তোষ কুমার দেব
পদ্মাসেতুতে রেল চলাচল শুরু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের নব দিগন্ত উন্মোচিত হলো এবং বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এলাকা।পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে প্রথম বারের মতো বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল করছে।পর্যটন সম্ভাবনার বৃহৎ উৎসস্থল হলো পদ্মাসেতু।
স্বপ্নের পদ্মাসেতু বাংলার মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণের অনন্য উদাহরণ।পদ্মাসেতুর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা সহ দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার সাথে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক যোগ সূত্র স্থাপন হবে।
এই যোগসূত্র স্থাপনের ফলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশের অনন্য অবদান রাখবে।পদ্মাসেতু দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইতিমধ্যে পদ্মাসেতুর দুই পাড় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে।প্রায় প্রতি দিন হাজার হাজার পর্যটক পদ্মার দুইপাড়ে নান্দনিক সৌন্দর্য দেখার জন্য ঘুরতে যায়। মাওয়া ও শরীয়তপুর প্রান্তে রেস্টুরেন্ট, রিসোর্ট, হোটেল-মোটেল সহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট নানা বিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট রয়েছে তন্মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ ও ম্যানগ্রোভফরেস্ট সুন্দরবন এই দুইটি হেরিটেজ দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত তবে অতীতে ওই অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক পর্যটকদের পছন্দের পর্যটন কেন্দ্র হওয়া স্বত্বেও ভ্রমণে আগ্রহ ছিল কম।পদ্মাসেতুর ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণ গুলোতে ভ্রমণে আগ্রহ বাড়বে।
পদ্মাসেতু দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার সাথে সংযোগ স্থাপন করবে।এই অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নের পদ্মাসেতু এখন বাস্তব।ঢাকার সাথে মংলা বন্দর, বরিশাল, কুয়াকাটা, পায়রাবন্দর, খুলনা, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর সহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যান্য জেলার অর্থনৈতিক খাতে এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।
এই পদ্মাসেতুর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে উপকৃত হবে।দেশের অর্থনীতিতে পদ্মাসেতুর ভূমিকা নিয়ে এর আগে বিশ্বব্যাংক বলেছিল, সেতু বাস্তবায়িত হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১দশমিক ২শতাংশ বেড়ে যাবে।আর প্রতি বছর দারিদ্র্য নিরসন হবে শূন্য দশমিক ৮৪ ভাগ।
দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণ গুলোর মধ্যে ভাসমান পেয়ারা বাজার, ঐতিহাসিক দুর্গা সাগর, কবি কৃষ্ণ চন্দ্র ইন্সটিটিউট, খান জাহান আলী সেতু, খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর, জাতিসংঘ পার্ক, দক্ষিণ ডিহি রবীন্দ্র কমপ্লেক্স, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের মাজার, রূপসা নদী, শহীদ হাদিস পার্ক, খান জাহান আলী কর্তৃক খনন কৃত বড় দীঘি, খুলনা শিপ ইয়ার্ড, গল্লামারী স্মৃতি সৌধও বধ্যভূমি, জাহানাবাদ বনবিলাস চিড়িয়াখানা ও শিশুপার্ক, পিঠাভোগ, প্রেমকানন বকুল তলা, মংলা পোর্ট, রাড়ুলী, রেলস্টেশনের কাছে মিস্টার চার্লির কুঠিবাড়ি, সোনাডাঙ্গা সোলারপার্ক ও অন্যান্য পর্যটন আকর্ষণ গুলোর চাহিদা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পাবে।
পর্যটকেরা কুয়াকাটা সমুদ্রের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে এবং খুব কম সময়ে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় স্পট -কচিখালী, কটকাসৈকত, জামতলাসী-বিচ, সুন্দরবন সংলগ্ন সাগরে জেগে ওঠা দ্বীপ পক্ষীরচর, ডিমের চর ঘুরে দেখার অপার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে।
কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবন, পায়রা বন্দরকে ঘিরে পর্যটন সম্ভাবনার নতুন দ্বার খুলবে পদ্মাসেতু এবং মাত্র ৬ ঘণ্টায় উপরের উল্লেখিত পর্যটন আকর্ষণ গুলোতে পর্যটকেরা যেতে পারবে।
অন্যদিকে কুয়াকাটার গা ঘেঁষে অবস্থিত ফাতরারচর, লালকাকড়ারচর, শুঁটকিপল্লী, লালদিয়ারচর, চরবিজয়, ফকিরহাট, সোনারচর, ক্র্যাবআইল্যান্ড বা কম কী? একটি স্পট থেকে আরেট স্পট নান্দনিক এছাড়াও রয়েছে ভিন্নরকম জীব-বৈচিত্র্যর সমারোহ।দারুণ সময় কাটাতে চাইলে এসব পর্যটন স্পটের জুড়ি পাওয়া কঠিন।
রাজধানী সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা স্বল্পসময়ে পণ্যপরিবহন করে মংলা বন্দরের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি গতিশীল হবে এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি হবে।কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত (যেখানে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়), ম্যানগ্রোভফরেস্ট সুন্দরবন সংলগ্ন ছোট ছোট দ্বীপ গুলোকে মালদ্বীপের ন্যায় পর্যটন আকর্ষণ তৈরি করা সম্ভব এবং সুন্দরবন ঘিরেও য়াইল্ডলাইফট্যুরিজম উন্নয়নের অনন্য সুযোগ রয়েছে।
প্রতি বছর পর্যটক বাহী ৪৫ টি ক্রুজ ভারতে কুচবিহার-চেন্নাই-গোয়া হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে চলে যায়।তবে এই ক্রুজ গুলো যদি পায়রাবন্দরে আকৃষ্ট করাযায় তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক উল্লেখ যোগ্য হারে বাড়বে।পদ্মাসেতু গতিশীল করবে মংলা ও পায়রাবন্দরকে যা সুনীল অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রাখবে।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল যেমন কুয়াকাটা , মংলা বন্দর ও পায়রাবন্দর কেন্দ্র করে সমুদ্র পর্যটনের সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে।নদী ভিত্তিক ও সমুদ্র ভিত্তিক পর্যটনে সময়োপযোগী সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তি মূলক ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের পাশাপাশি তৈরি করবে কর্মসংস্থান সুযোগ, শক্তিশালী হবে জাতীয় অর্থনীতি।
তবে আন্তর্জাতিক পর্যটক আকর্ষণের জন্য পদ্মাসেতুর ও দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটন আকর্ষণ গুলো ছোট ছোট প্রমো তৈরি করে ডিজিটাল ব্র্যান্ডিং করা প্রয়োজন।
লেখক:চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।