বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে একটি বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে আসছে, যা ১৯৭২ সালে সংবিধানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সন্নিবেশিত করেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর এই কূটনৈতিক দর্শনকে সমুন্নত রেখে কাজ করে চলেছেন। দক্ষ কূটনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে বাংলাদেশ একদিকে যেমন জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করেছে, ঠিক তেমনি চীন ও ভারতের মতো বিশ্ব পরাশক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হচ্ছে।

১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির মূলে ছিল শান্তিপূর্ণ, সহযোগিতামূলক এবং প্রগতিশীল জাতি গঠনের আকাঙ্ক্ষা। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতিটি ছিল কূটনৈতিক অবস্থানের চেয়েও একটি কৌশলগত কাঠামো– যার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করা এবং একটি অশান্ত আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে এর উন্নয়নকে সহজ করা।

পিতার দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরাধিকারী হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতাকে দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রশাসন সূক্ষ্মভাবে একটি বৈদেশিক নীতি তৈরি করেছে, যেখানে অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রতিবেশী দেশ এবং পরাশক্তিদের সঙ্গে যে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা দেশের উন্নয়নের গতিপথকে শক্তিশালী করে যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করে চলেছে।

চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ় অর্থনৈতিক সহযোগিতা দ্বারা চিহ্নিত। পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং অসংখ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো পরিকাঠামো প্রকল্পসহ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় বাংলাদেশে যথেষ্ট বিনিয়োগ রয়েছে। এই বিনিয়োগ শুধু বাংলাদেশের পরিকাঠামোকেই উন্নত করেনি, কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করেছে। চীনা বিনিয়োগের অর্থায়নে প্রধান পরিকাঠামো প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের পরিবহন ও জ্বালানি খাতকে আধুনিক করেছে, যা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। চীন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার, যার সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার। চীনা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা প্রযুক্তি হস্তান্তরকে সহজতর করার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্বারা চিহ্নিত। ফলে এই সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক করে চলেছে। দুই দেশ বাণিজ্য ও বিনিয়োগ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় পর্যন্ত অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যাপক সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে গত ১৫ বছরে।

বাংলাদেশ থেকে রফতানির ক্ষেত্রে ভারত অন্যতম বড় বাজার। দুই দেশ বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করেছে যার মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জ্বালানি গ্রিডসহ জ্বালানি খাতে যৌথ উদ্যোগ বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে জোরদার করেছে, যা শিল্প বিকাশের জন্য অপরিহার্য। রেল ও সড়ক সংযোগের মতো আঞ্চলিক সংযোগ বাড়ানোর পরিকাঠামো প্রকল্পগুলো মসৃণ বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহনকে সহজতর করেছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে উপকৃত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কোনও একটি দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এড়াতে অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের বৈচিত্র্যের ওপর জোর দিয়ে কাজ করে চলেছে। এই কৌশলটি বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন করে এমন বিনিয়োগ, সহায়তা এবং বাণিজ্য চুক্তিগুলো সুরক্ষিত করতে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যিক অংশীদার।

জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি)-এর আওতায় ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম রফতানি রেমিট্যান্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য অনুকূল কাজের পরিবেশ এবং মজুরি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে সরকার।

বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার উন্নতির জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। সরকারের বৈদেশিক নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অর্থায়ন এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশে অসংখ্য দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে অর্থায়ন করার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে উদ্দীপিত করেছে। আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় বিনিয়োগ মানবসম্পদ উন্নয়নে অবদান রেখেছে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি ভিত্তি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অনুদান এবং ঋণ পরিকাঠামো প্রকল্পগুলোকে সমর্থন করেছে, অর্থনৈতিক সংযোগ এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করেছে।

যদিও বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক নীতি দেশের জন্য যথেষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা আনতে সক্ষম হয়েছে, তবে সরকারের উচিত চীন ও ভারতসহ ক্রমাগত ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা বিবেচনায় রেখে কাজ করে যাওয়া। এই সম্পর্কগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিচক্ষণ কূটনীতি প্রয়োজন, যাতে বাংলাদেশ আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে না পড়ে উভয়ের থেকে সুবিধা নিতে পারে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রতি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই হয় তা নিশ্চিত করা সরকারের একটি অগ্রাধিকার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর জন্য অবিচ্ছিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক মান মেনে চলা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিগত ও শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং উদ্ভাবন ও গবেষণায় সহযোগিতা বাড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’– যে নীতিটি বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা অব্যাহত রেখেছেন, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কৌশলগত অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ সফলভাবে জটিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালনা করেছে, বিনিয়োগ সুরক্ষিত করেছে, বাণিজ্য বৃদ্ধি করেছে এবং টেকসই উন্নয়ন উৎসাহিত করেছে। জাতি যতই এগিয়ে যাবে, সরকারের বৈদেশিক নীতি দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলবে। তাহলে বিশ্বমঞ্চে গতিশীল এবং শক্তিশালী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারবে।

লেখক: অধ্যাপক, লোক-প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি