সেন্টমার্টিন দ্বীপ সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য:কল্পকাহিনি থেকে সত্যকে আলাদা করতে হবে

ড. প্রণব কুমার পান্ডে

কয়েক মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, কারণ আরাকান সেনাবাহিনী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে। সশস্ত্র সংঘাতের কারণে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) বাংলাদেশ সীমান্তের কাছাকাছি কিছু এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। তাছাড়া, আরাকান সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যের উল্লেখযোগ্য এলাকা দখল করে নিয়েছে।

মিয়ানমারে চলমান ‘গৃহযুদ্ধের’ পরিণতির কারণে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে যেন জনগণ আতঙ্কিত হয়ে না পড়েন সেজন্য বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীলরা এই বিষয়ে বিবৃতি প্রদান করে চলেছেন।

যেহেতু, মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠী কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে, ফলে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কখনও কখনও অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তবে, বাংলাদেশ সরকার সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের অনুসারীরা, এই ঘটনাগুলোকে দেশের পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করার জন্য ব্যবহার করে দাবি করছে যে সরকার দুর্বল কূটনীতির কারণে মিয়ানমার সরকারের প্রতি কঠোর বার্তা প্রেরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাছাড়া এই গোষ্ঠী সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যে রক্তপাত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং চলমান ঘটনার মাধ্যমে মিয়ানমারজুড়ে অস্থিতিশীলতার একটি বৃহত্তর প্রবণতা ফুটে উঠেছে। স্বায়ত্তশাসন বা আরও অধিকারের দাবিতে বেশ কয়েকটি জাতিগত গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেশটিকে বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় জর্জরিত করে রেখেছে। সামরিক বাহিনীর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং মিয়ানমার সরকারের জবরদস্তিমূলক নীতিগুলো এই বিষয়গুলোকে আরও খারাপ করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধীদের মধ্যে রয়েছে আরাকান আর্মি, যা রাখাইন সম্প্রদায়কে প্রতিনিধিত্ব করে। তাদের মূল দাবি রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন।

ফলে, চলমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য একটি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে। একদিকে সরকারকে যেমন জনগণের, বিশেষ করে যারা সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিদর্শন করেন এবং সীমান্ত অঞ্চলে বসবাস করেন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে তাদের। অন্যদিকে, সরকারকে অবশ্যই আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির জটিল সমীকরণের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানোর সিদ্ধান্তের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) চলমান সমস্যা এবং এই বিষয়ে বিভিন্ন মিথ্যা তথ্য প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় বিষয়গুলো পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। আইএসপিআর-এর বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আরাকান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথ অপারেশন পরিচালনা করছে। এই কার্যকলাপের ফলে নাফ নদী এবং অন্যান্য মোহনায় বাংলাদেশি নৌকাগুলোর ওপর অনাকাঙ্ক্ষিত গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সীমান্তে শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১২ জুন সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশের সমুদ্র রক্ষী বাহিনী ক্রমাগত সামুদ্রিক সীমান্তে টহল দিচ্ছে এবং বাংলাদেশি জলপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছে। এই উদ্যোগগুলো সত্ত্বেও, সেন্টমার্টিনের দ্বীপের নিরাপত্তা সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে বিধায় জনসাধারণের মনে কিছুটা উদ্বেগ জন্ম নিয়েছে।

আইএসপিআর-এর বিবৃতিসহ কূটনৈতিক মন্তব্যগুলো সরকারের সতর্ক অবস্থানের পরিচায়ক, যার মাধ্যমে যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে তা হলো সরকার এই বিষয়টির জটিলতা সম্পর্কে সচেতন। তবে, বিএনপি ও তাদের সমর্থকদের সমালোচনা স্থানীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা প্রদান করতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই ধরনের মিথ্যা তথ্য ছড়ানো নতুন কিছু নয়। ফলে, দুর্বল বৈদেশিক নীতির অভিযোগ তুলে কোনও রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করতে সক্ষম হবে না বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী।

তবে, বাংলাদেশ সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে জোরালো পদক্ষেপের মাধ্যমে এই অভিযোগগুলোর জবাব দিতে হবে, যা জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করবে। এক্ষেত্রে, নৌবাহিনী এবং উপকূলরক্ষী বাহিনীর উন্নত টহল একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি হতে পারে। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির জন্য এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তকে সম্মান জানাতে আঞ্চলিক রাষ্ট্রসমূহ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে যুক্ত করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।

ইতোমধ্যে, বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খাঁন কামাল আরাকান সেনাবাহিনী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে একটি কঠোর সতর্কবার্তা প্রদান করা হয়েছে মর্মে মিডিয়ায় বলেছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোনও গুলি চালানোর ঘটনা মেনে নেওয়া হবে না। এই বিবৃতিটির মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতির বিষয়টি ফুটে উঠেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সতর্কবার্তা এই ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করবে এবং রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত সংকটের বিস্তারের বিরুদ্ধে দেশের সীমান্ত রক্ষায় বাংলাদেশের সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতিকে নির্দেশ করে।

তাছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মিথ্যা তথ্য এবং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সমন্বিত যোগাযোগ প্রচেষ্টার প্রয়োজন। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপের ওপর জোর দেওয়া উন্মুক্ত সরকারি যোগাযোগ জনসাধারণের উদ্বেগ দূর করতে এবং আতঙ্ক কমাতে করতে সহায়তা করবে। রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত আমাদের মিয়ানমারের শান্তি ও নিরাপত্তার ভঙ্গুর পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার মাধ্যমে দেশের শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিষয়টি উঠে এসেছে।

সাধারণত, বিরোধী দলগুলো  সরকারের যেকোনও সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাদের মতামত প্রকাশ করে। রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য সরকারের সমালোচনা করার অধিকার তাদের রয়েছে। তবে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মিথ্যা তথ্য প্রচার উচিত নয়। বাংলাদেশের জনগণ প্রধানমন্ত্রীকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, যিনি গত ১৫ বছর ধরে দেশের উন্নয়নের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। ফলে, বিরোধীদের প্রচার করা বিভ্রান্তিকর তথ্য সরকারের অবস্থানের ক্ষতি করবে না। ফলে, জনগণের উচিত সেন্টমার্টিন দ্বীপ সম্পর্কিত  মিথ্যা ও কল্পকাহিনীকে বিশ্বাস না করে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করা।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি