শেখ হাসিনার তীক্ষ্ণ কূটনীতি ‘তিস্তায় পানি লাগবেই’

পলাশ আহসান

এবছরও রংপুরে পানির অভাবে সেচ সুবিধার বাইরে ছিল ৩৯ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমি। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ দিয়ে এবারও শুষ্ক মৌসুমে ঠিকঠাক পানি আসেনি। তার চেয়ে বড় কথা এই প্রকল্পের সঙ্গে আছে উত্তরবঙ্গের ছয়ে জেলা। নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, গাইবান্ধা এবং জয়পুরহাট। এর আওতায় আছে ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। প্রতিটি জেলার অবস্থাই একই রকম।

খাদ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তার পানির ঘাটতির কারণে প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন কম হয়। ওই গবেষণায় বলা হয় তিস্তার পানি সমস্যার সমাধান না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ কমে যাবে।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। যা বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেরই অংশ। ভারতের সিকিমে জন্মে নদীটি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে এসেছে বাংলাদেশের রংপুর। এর পর মিশেছে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে। তিস্তার অববাহিকার দৈর্ঘ্য ১২ হাজার ১৫৯ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশ ও ভারতের তিন কোটিরও বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত এই নদীর সঙ্গে। এর মধ্যে দুই কোটি মানুষের বসবাস বাংলাদেশে। এক কোটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও সিকিমে। তাদেরও কয়েকলাখ একর জমির চাষাবাদ তিস্তার ওপর ভর করে। বিশেষজ্ঞদের মতে ১৯৭৬ সালে দুই দেশে নীলফামারীর ডিমলা এবং পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় দুটি পাল্টাপাল্টি ব্যারাজ নির্মাণ করে। মূলত সেই থেকে দুই দেশের কৃষকদের মহা সঙ্কটের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে তিস্তা। এই সঙ্কট নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। বিরুদ্ধাচারণ হয়েছে। এমনকী নির্বাচনী ইস্যুও হয়েছে। কিন্তু কৃষক স্বস্তি পাননি। সঙ্কটের সমাধানও হয়নি।

তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে চুক্তির একটি খসড়া চূড়ান্ত হয়েছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির ৩৭ দশমিক ৫ ভাগ বাংলাদেশের এবং ৪২ দশমিক ৫ ভাগ ভারতের পাওয়ার কথা ছিল। বাকি ২০ ভাগ রাখার কথা ছিল নদীর পরিবেশ রক্ষার জন্যে। কিন্ত হয়নি। আবার ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তার পানি নিয়ে একই রকম একটি চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কারণে শেষ মুহূর্তে চুক্তিটি হয়নি। নরেন্দ্র মোদির সরকারও তিস্তার পানি চুক্তির ব্যাপারে একাধিকবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করে গেছে। কিন্তু বিষয়টি অমিমাংশিতই রয়ে গেছে।

তিস্তা সমস্যা সমাধান না হ্ওয়ার জন্যে বার বার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতার কথা বলা হয়। এনিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সব সময় গণমাধ্যমে বলেন, তিস্তার পানির যে ভাগ পশ্চিমবঙ্গ পাবে সেটা তো তাকে নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশকে যে পরিমাণ পানি দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা তখনই সম্ভব যদি পাহাড়ী এলাকায়, সিকিমে, পানি বেশি থাকে। সেটা কিন্তু নেই। পশ্চিমবঙ্গকে প্রযুক্তি দিয়ে বোঝাতে হবে যে, তিস্তা চুক্তি হলে এ রাজ্যের ক্ষতি হবে না। সম্প্রতি কলকাতার মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট ফর এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক ড. শ্রীরাধা দত্ত বলছিলেন, তিস্তা নিয়ে যখন চুক্তি হচ্ছিল চলেছিল, তখন পানি প্রবাহের ঠিকঠাক পরিমাণ আমাদের জানা ছিল না। সবসময়েই নদীর জলপ্রবাহের ক্ষেত্রে ৩০ বছরের একটা গড় হিসাব করা হয়। যে হিসাব তখন ছিল, সেটা অনেক পুরনো। তাই সেই পুরনো হিসাবের ওপর ভর করে চুক্তি করাটা বোধহয় ঠিক হত না।

যা্ই হোক, এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ ও ২২ জুন ভারত সফর করেন। ২২ জুন তিনি দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। সেখানে উঠে আসে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টিও। সেখানে চুক্তির পাশাপাশি উঠে আসে তিস্তা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও। বৈঠকে দুই দেশের এক যৌথ ঘোষণায় মোদী বলেন, ‘আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে, পানি বণ্টনের কাঠামো তৈরী করবো। আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে, আমরা পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনাও করব। এই সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলতে শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে একটি কারিগরি দল।’

যৌথ ঘোষণায় পরিষ্কার করে বলা হয়, যৌথ নদীর পানি ভাগাভাগির বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে। তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ যে মেগা প্রকল্প হাতে নিচ্ছে, তাতে ভারতও যুক্ত হবে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো নদী অববাহিকা দক্ষতার সাথে পরিচালনা করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা এবং গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশে পানি সংকট মোকাবিলা করা। বাংলাদেশের এই তিস্তা ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ প্রকল্পে ভারত যুক্ত হলে ভারত থেকে পানি এনে তিস্তায় সংযুক্ত করে সংকটের সমাধান করা সহজ হবে। সম্প্রতি ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিকল্প পথে তিস্তা পাড়ের মানুষের দুঃখ মোচনের যে চেষ্টা চলছে তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারেরও সায় আছে। এরই মধ্যে তারা উত্তরবঙ্গের তোর্সা-দুধকুমার-সঙ্কোশ-ধরলার সহ আরও যে সব নদীতে উদ্বৃত্ত পানি আছে তা খাল খনন করে বাংলাদেশের তিস্তা অববাহিকায় পাঠানোর পক্ষে মত দিয়েছে।

এখন সার্বিক অবস্থা দেখে যা মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ ও ভারত দুই সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে চায়। কিন্তু আঞ্চলিক রাজনীতি এবং চুলচেরা গবেষণার কারণে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ঝুলে আছে। চুক্তির আগে সেই বিষয়গুলোর মিমাংসা করতে হবে। তাই আপাতত যৌথ ঘোষণাপত্রে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্প সমাধানের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। বলা হয়েছে, যৌথ নদী কমিশন এ বিষয়ে প্রস্তাব করবে এবং তার পরেই বিকল্প সমাধানগুলো সুনির্দিষ্ট হবে। এরই মধ্যে দুই দেশের পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরা এই ঘোষণায় স্বাগত জানিয়েছেন। কারণ তারা ভাবছেন, যে ভাবেই হোক তিস্তা অববাহিকায় পানি ব্যবস্থাপনা জরুরি। তা খালের মাধ্যমেই আসুক কিংবা অন্য কোনো ভাবে।

শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনার যে বিষয়টি সামনে আসছে সে বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়েছে বেশ আগে। কয়েক মাস আগে ভারতের বিদেশ সচিব বিনয় কোয়াত্রার বাংলাদেশে সফরের পর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে শুকনো মৌসুমে বর্ষার পানি সংরক্ষণ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ঢাকার পরিকল্পনা, ভারতের অর্থায়নে তিস্তা ব্যারাজের চারপাশে একটি জলাধার তৈরি করা। কারণ, ভারত নদীতে বাঁধ দেওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্মকালে যেমন সমস্যায় পড়ছেন, তেমনই বর্ষাকালেও সমস্যায় পড়ছেন। সিকিমে ভারত একাধিক বাঁধ তৈরি করেছে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য। এই প্রতিটি বাঁধের কারণে অন্তত পাঁচ শতাংশ করে পানি কম আসছে বাংলাদেশে। সুতরাং এই সমস্যা সমাধানে ভারতের অংশগ্রহন্ও জরুরি।

এর আগে আরও ছয় বছর আগে শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ‘চীনের দুঃখ’ হিসেবে পরিচিত হোয়াংহো নদী বা ইয়েলো রিভারকে তিনি যে ভাবে ‘চীনের আশীর্বাদে’ পরিণত করেছেন একই ভাবে বাংলাদেশের তিস্তা নদীরও একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এনে দেয়ার। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়ে চীনা অর্থায়নে একটি প্রকল্প-প্রস্তাব দেয়া হয়। এবারের ভারত সফরে গিয়েও তিনি ভারতের কাছে চীনের সেই প্রকল্পের কথা বলেছেন। এখানে কেউ কেউ চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরী কূটনৈতিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা নিজেই বিষয়টি পরিস্কার করেছেন তার এবারের ভারত সফর নিয়ে প্রেসব্রিফিংএ । সেখানে তিনি পরিস্কার করে বলেছেন, তার পররাষ্ট্রনীতির কথা। ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, চীন-ভারতের কী সম্পর্ক আছে সেটা তার জানার বিষয় নয়। তার দরকার পানি। সেটা তিনি আনবেনই। যে কারণে কূটনীতির সব পথ তিনি খুলে রেখেছেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি