জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় সরকারের উদ্যোগ

‘জনগণ’শব্দটিরব্যবহারকখনোযথার্থ, কখনো আবার উদ্দেশ্য প্রণোদিত। অনেকের নিকট ‘জনগণ’ শব্দটির অর্থ দুর্বোধ্য। অভিধান বলছে, ‘জনগণ’ অর্থ রাষ্ট্র বা সমাজের অধিকাংশ লোক। ‘জনগণ’ শব্দের প্রায়োগিক ভিন্নতা থাকলেও ‘জনস্বার্থ’ শব্দের অর্থ কিন্তু খুবই সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। সরকারের নির্দেশে জনগণ বা জনগণের কিয়দংশের স্বার্থে গৃহীত কর্মই জনস্বার্থ। সরকার জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্যের অবাধ প্রবাহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীকে নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) আইন, ২০১১’প্রণয়ন করেছে। এ আইনকে‘তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯’-এর পরিপূরক আইন হিসাবেও বিবেচনা করা হয়। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) আইনের মাধ্যমে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ভিত্তি রচিত হয়েছে। যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারের আন্তরিকতার বহিঃ প্রকাশ।

‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) আইন, ২০১১’আকারে খুব ছোটো হলেও এই আইনের কার্যকারিতা সুদূর প্রসারী। কোন কোন তথ্য জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্যের আওতাভুক্ত হবে, তা আইনে সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, সরকারি অর্থের অনিয়মিত ও অননুমোদিতব্যয়; সরকারি সম্পদের অব্যবস্থাপনা; সরকারি সম্পদ বা অর্থ আত্মসাৎ; ক্ষমতার অপব্যবহার বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা; ফৌজদারি অপরাধ বা বেআইনি বা অবৈধকার্য সম্পাদন; জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বা ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কার্যকলাপ এবং দুর্নীতি-সংক্রান্ত তথ্যকে ‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য’হিসাবে বিবেচনা করা হবে। এই আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী, কোনো তথ্য প্রকাশকারী উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের নিকট জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে পারবেন। আইনের ধারা ৫-এ তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ধারা ৫ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে, ওই ব্যক্তির সম্মতি ব্যতীত তাঁর পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্টসঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে তথ্য প্রকাশকারীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোনো বিভাগীয় মামলা দায়ের করা যাবে না। এছাড়া, তথ্য প্রকাশকারী কোনো চাকরিজীবী হলে শুধু জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশের কারণে তাঁকে পদাবনতি, হয়রানিমূলক বদলি বা বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা যাবে না। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে এ রকম কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যা তাঁর জন্য মানসিক, আর্থিক বা সামাজিক সুনামের জন্য ক্ষতিকর হয় বা তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কোনো প্রকার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।

তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা সম্পর্কে আইনের ধারা ৫-এ বর্ণিত উল্লিখিত নির্দেশনা জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করণের একটি বড়ো পদক্ষেপ। তবে তথ্যের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিত না হয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ কারী উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে কোনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করলে এই আইন অনুযায়ী তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে এবং এই অপরাধের জন্য তিনি অন্যূন ২ বছর বা অনধিক ৫ বছর সশ্রমকারাদ-ে বা অর্থদ-ে বা উভয়দ-ে দ-িত হবেন। কোনো সরকারি কর্মচারী উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে কোনো ভিত্তিহীন তথ্য প্রকাশ করলে উল্লিখিত দ- ছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

সরকার‘জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) আইন, ২০১১’-এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) বিধিমালা, ২০১৭’প্রণয়ন করেছে। এই বিধিমালার অধীন দায়িত্ব পালনের জন্য সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তাকে‘ডেজিগনেটেড অফিসার’হিসাবে দায়িত্ব পালনের বিধান রাখা হয়েছে। এই বিধিমালায় জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে করণীয়, প্রাথমিক তদন্ত প্রক্রিয়া, পুলিশ কর্তৃক গৃহীতব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা, জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ ফর্ম প্রভৃতি বিষয় সন্নিবেশিত হয়েছে। এছাড়া এই বিধিমালায় জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্টসত্য তথ্য প্রকাশ কারীর জন্য পুরস্কার বা সম্মাননা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যা জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে।

দেশে অনেক সৎ ও দেশ প্রেমিক মানুষ রয়েছেন, যাঁরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে ভয়পান। এই আইন নিশ্চিত ভাবে ওইসব সৎ ও দেশ প্রেমিক মানুষকে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করবে। সরকারি কর্মচারীগণ ও অনেক সময় ঊর্ধ্বতনকর্তৃপক্ষের দুর্নীতি মুখ বুজে সহ্য করেন। এই আইন সরকারি কর্মচারী গণকেও জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশে উৎসাহিত করবে।

‘জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষাপ্রদান) আইন, ২০১১’নিঃসন্দেহে একটি উত্তম আইন। এই আইনের উদ্দেশ্য খুবই মহৎ। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই আইনের রয়েছে কার্যকর ভূমিকা। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। আর এই জনগণের নিরাপত্তার জন্যই এই আইন। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারী প্রত্যেক নাগরিক এই আইনকে নিরাপত্তার অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করলে দেশে কেউ দুর্নীতি করার সাহস পাবেন না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটি বৃহৎ অংশ এখনো এই আইন সম্পর্কে কিছুই জানেন না। জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশকারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যে রাষ্ট্র নিয়েছে, তা জনগণকে যত দ্রুত জানানো যায়, ততই দেশের জন্য মঙ্গল। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি প্রচার মাধ্যম সমূহকেই এই প্রচারের দায়িত্ব নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক নাগরিক এই আইন সম্পর্কে জানবেন এবং দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে প্রকাশ করবেন, এমনটাই প্রত্যাশা। (পিআইডিফিচার)

লেখক :বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং সিনিয়র তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত

  • Related Posts

    রংপুরে দুই দিনব্যাপী তথ্যমেলার উদ্‌বোধন

    তথ্যই শক্তি জানব জানাবো, দুর্নীতি রুখবো স্লোগানে রংপুরে দুই দিনব্যাপী তথ্যমেলার উদ্‌বোধন করা হয়েছে। রবিবার (২২শে ডিসেম্বর) বিকালে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে বেলুন উড়িয়ে এই…

    Continue reading
     রংপুরে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস ২০২৪ উদ্‌যাপিত

    ‘প্রবাসীর অধিকার, আমাদের অঙ্গীকার, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, আমাদের সবার’ এই প্রতিপাদ্যে রংপুরে আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস ও জাতীয় প্রবাসী দিবস ২০২৪ উদ্‌যাপিত হয়েছে। বুধবার (১৮ই ডিসেম্বর) সকালে রংপুর জেলাপ্রশাসন, জেলা কর্মসংস্থান ও…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি