মো. মামুন অর রশিদ
দেড় দশক আগেও বাংলাদেশে অর্থের অভাবে আইনের আশ্রয়বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আইনের আশ্রয়বঞ্চিত অনেকেই চোখের জলে অন্তরের চাপা ক্ষোভ প্রশমন করেছেন।কেউ কেউ আবার সৃষ্টিকর্তার নিকট বিচার দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। এভাবে কত যে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতি কেঁদেছে, তার হিসাব নেই। সময় পরিবর্তন হয়েছে। এখন গরিব-অসহায় মানুষের আদালতে বিচারপ্রার্থী হতে অর্থের প্রয়োজন নেই। সরকার নিজেই গরিব-অসহায় মানুষকে আইনগত সহায়তা প্রদান করছে। যা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম পূর্বশর্ত।
বাংলাদেশেআইনগতসহায়তারধারণাকাঠামোগতভাবেনতুনহলেওসাংবিধানিকআইনেরইতিহাসেএটিবেশপুরোনো।আইনগত সহায়তার মূল ভিত্তি হলো সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ। ২৭অনুচ্ছেদেবলাহয়েছে, ‘সকলনাগরিকআইনেরদৃষ্টিতেসমানএবংআইনেরসমানআশ্রয়লাভেরঅধিকারী।’ সরকারি আইনি সহায়তা ছাড়া কোনোভাবেইসকল নাগরিকের জন্য আইনের সমান আশ্রয় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। কারণ সমাজের সকলের আর্থিক সামর্থ্য সমান নয়।সচ্ছলমানুষেরপক্ষেআইনেরআশ্রয়লাভকরাযতটা সহজ, দরিদ্রও অসহায় মানুষেরপক্ষেঠিকততটাইকঠিন।রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হলোদরিদ্রও অসহায় মানুষকে সরকারি আইনগত সহায়তা প্রদান করা।এই দায়িত্ববোধ থেকে সরকার আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ জনগোষ্ঠীকে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’ প্রণয়ন করে। ২০০০ সালের ২৮শে এপ্রিল থেকে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন কার্যকর হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০০০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রম শুধু আইন ও নীতিমালার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ২০০৯ সালে সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।
‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’-এর আওতায় সরকার ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে আইনি সেবা প্রদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যেএ সংস্থার অধীনে প্রত্যেক জেলার জজকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত হয় জেলা লিগ্যাল এইড অফিস। প্রত্যেকটি জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে সরকারসহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ পদমর্যাদার একজন বিচারককে ‘জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার’হিসাবে পদায়ন করে। জেলা পর্যায়ে লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপনের পাশাপাশি সরকার‘সুপ্রীম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস’ এবং ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল’প্রতিষ্ঠা করেছে।
এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটি এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। চৌকি আদালতে ও শ্রম আদালতে গঠিত হয়েছে বিশেষ কমিটি। এসব কমিটির সহযোগিতায় লিগ্যাল এইড অফিসসমূহ আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থসামাজিক কারণে বিচার পেতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থী ও শ্রমজীবী জনগণকে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করছে।লিগ্যাল এইড অফিস প্রদত্ত আইনগত সেবার মধ্যে রয়েছে : আইনগত পরামর্শ প্রদান;মামলা করার পূর্বে বিরোধ নিষ্পত্তি করা (প্রি-কেইস মেডিয়েশন); চলমান মামলা রেফার করার ভিত্তিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি করা (পোস্ট কেইস মেডিয়েশন); বিনামূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ; মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ; আইনজীবীর ফি পরিশোধ; মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানি পরিশোধ; বিনামূল্যে রায় কিংবা আদেশের নকল সরবরাহ;ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ;ফৌজদারি মামলায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ এবং মামলার সাথে সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট প্রবিধানমালায় নির্ধারিত প্রাসঙ্গিক সকল ব্যয় পরিশোধ।
গত দেড় দশকে (২০০৯ সাল থেকে অদ্যাবধি)সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় মোট ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৬টি মামলায় আইনি সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে আইনি সহায়তার মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৯৪ হাজার ১২২টি।উল্লিখিত সময়ে আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের অধীন ৪ লাখ ৫ হাজার ৯২ জনকে আইনি পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি আইনি সহায়তার জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টার (টোলফ্রি ‘১৬৪৩০’) থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেছেন ১ লাখ ৬৪ হাজার ৭৯৭ জন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ১০ লাখ ২২ হাজার ৯৫৮। এ ছাড়া আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত মামলা থেকে আদায়কৃত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ১৮৭ কোটি ৪৪ লাখ ৬১ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকা।
সরকার আইনগত সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১৫ সালে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে ‘আইনগতসহায়তাপ্রদান (আইনি পরামর্শওবিকল্পবিরোধনিষ্পত্তি) বিধিমালা২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রমের আওতায় লিগ্যাল এইড অফিসারগণ এ পর্যন্ত ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৩টি বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন। আইনি বিধি-বিধানের অধীন বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় দিনদিন লিগ্যাল এইড অফিসের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।
তবে এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো সরকারি আইনগত সহায়তা কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত নন।সরকারিআইনগতসেবা-সংক্রান্তবার্তাঅসহায়, দরিদ্রওসুবিধাবঞ্চিতজনগোষ্ঠীরনিকটপৌঁছেদিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়িত্ব নিতে হবে। মোবাইল থেকে ১৬৪৩০ নম্বরে কল করলে যে বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ পাওয়া যায়, এ বিষয়টিও ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। এ ছাড়া, মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকেও সরকারি আইনগত সেবার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
আইনগত সহায়তা ও মৌলিক অধিকার একটি অপরটির পরিপূরক। সমাজের দরিদ্র-অসহায় নাগরিকদের আইনগত সহায়তা পাওয়ার সঙ্গে দেশের আইনের শাসন, ন্যায়বিচার ও সামাজিক সমতা জড়িত। রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থাপনায়আইনগতসহায়তাপ্রদানকরারাষ্ট্রেরকোনোবদান্যতানয়, বরংএটিঅসচ্ছলওদরিদ্রমানুষেরঅধিকার।রাষ্ট্রনাগরিকেরএঅধিকাররক্ষাকরতেসাংবিধানিকভাবেঅঙ্গীকারবদ্ধ। আইনগত সেবা প্রদানে সরকারেরগৃহীত বহুমুখীউদ্যোগেরফলে গত দেড় দশকে সরকারিআইনিসহায়তাকর্মক্রমের যেঅগ্রগতিসাধিতহয়েছে, তা সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ভবিষ্যতে ‘লিগ্যাল এইড’ অসহায় বিচারপ্রার্থীদের আস্থার বাতিঘরে পরিণত হবে, এমনটাই প্রত্যাশা।(পিআইডি ফিচার)
লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং সিনিয়র তথ্য অফিসার পদে আঞ্চলিক তথ্য অফিস, রংপুর-এ কর্মরত