স ম মাহবুবুল আলম
জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের একটি অংশের মধ্যে ধারণা আছে, চিকিৎসকরা অর্থলিপ্সু, রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না, রোগীদের সময় কম দেন, চিকিৎসায় ভুল করেন ইত্যাদি। অন্যদিকে চিকিৎসকরা কর্মক্ষেত্রে শারীরিকভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তার কর্মক্ষেত্র মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ নয়। একদা আজকের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মুখের ওপর ফাইল ছুড়ে দেওয়া হয়েছে, সেই অপমান বুকে চেপে রেখে তিনি কাজ করে গেছেন। আমার এক চিকিৎসক বন্ধু মারামারিতে আহত রোগীকে দেখতে গিয়েছেন, সেখানে তাকে বসে থাকা চেয়ার থেকে উঠিয়ে দিয়ে পুলিশ কনস্টেবলকে বসতে দেওয়া হয়েছে। ক্ষোভে হেলথ ক্যাডার ছেড়ে, আমার সেই বন্ধু পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন।
বহু নীতিনির্ধারক মনে করেন, চিকিৎসকরা মানবিক হলে, টাকার লোভ কম করলে, একটু আন্তরিক হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন চিকিৎসক। তিনি মনে করছেন চিকিৎসকদের পদ-প্রমোশন দিয়ে, তাদের বঞ্চনা দূর করে, আহত চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়িয়ে, চিকিৎসকদের অনুপ্রাণিত ও কর্তব্যনিষ্ঠ করে, কড়াকড়ি আরোপ করে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গুণগত উন্নতি অর্জিত হবে।
এ সবকিছুই একটি অত্যন্ত দুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামোর অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়ের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে একটি ভুল ধারণাগত ভ্রান্তির বৃত্তে নীতিনির্ধারক, জনগণ ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা ঘুরপাক খাচ্ছেন।
স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত করে, চিকিৎসক ও নার্সদের চেতনার গুণগত মান পরিবর্তন করে স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তনের সূচনা ঘটানোর চিন্তা একটি অলীক কল্পনা।
এটা এখন কোনও ভণিতা না করে সরাসরি বলা যায়, স্বাস্থ্য খাতে যথার্থ বাজেট বরাদ্দ না করে একদল ‘ফেরেশতা’ দিয়ে স্বাস্থ্য খাত পরিচালনা করলেও কেয়ামত পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থার উন্নতি হবে না।
গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম, যা এই দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাজেটে জিডিপি’র যথাক্রমে- মালদ্বীপে ৯.১%, ভুটানে ৩.৪%, শ্রীলঙ্কায় ১.৯%, নেপালে ১.৬%, আফগানিস্তানে ১.২ %, ভারতে ১.১% , পাকিস্তানে ১% আর বাংলাদেশ ০.৪৭ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রেখেছে। শিল্পোন্নত দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে তাদের জিডিপি’র ১০.৭ ও ১০.২ শতাংশ বরাদ্দ করে বাজেটে। আমাদের মতোই কিছু দেশ, যেমন- ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে জিডিপি’র যথাক্রমে ২.১, ৩.১ এবং ৬.৯ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে। এই দেশগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ৩ লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। দেশগুলোতে চিকিৎসা করতে গিয়ে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্স-ওওপি বা সরকারি খরচের বাইরে ব্যক্তি যে ব্যয় করে) হ্রাস পেয়ে এখন যথাক্রমে ৪০, ১১ ও ৩২ শতাংশ। বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটছে, আউট অব পকেট এক্সপেন্স এখানে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে সম্প্রতি নতুন সরকার গঠনের প্রাক্কালে, ‘নতুন সরকার কোন পথে স্বাস্থ্যসেবায় দ্রুত উন্নয়ন আনতে পারে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আশু পরিবর্তনের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ১১ দফা প্রস্তাবনা রেখেছিলাম। প্রথম প্রস্তাবনাটি ছিল আগামী বাজেটেই স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি’র ২ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে। অতঃপর পর্যায়ক্রমিকভাবে পরবর্তী বাজেটগুলোতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশকৃত বরাদ্দ জিডিপি’র ৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানোর কথা উঠলেই একদল সমালোচক বলে ওঠেন, স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ বাজেটই বাস্তবায়ন করতে পারে না, তারা আরও বাজেট বরাদ্দ দিয়ে কী করবে! তার সঙ্গে তারা স্বাস্থ্য খাতের সীমাহীন দুর্নীতির উদাহরণ সামনে এনে বরাদ্দের বিরোধিতায় নামেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর গড় বাস্তবায়নের হার ছিল ৮১ শতাংশ। শুধু স্বাস্থ্য খাত নয়, সামগ্রিকভাবেই আমাদের বাজেট বাস্তবায়ন সক্ষমতার ঘাটতি আছে। আমাদের বাজেট প্রণয়নের ভেতর গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে বাজেট তৈরি না করলে বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ কম। আমাদের দেশে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় বাজেট তৈরি করা হয়। অর্থাভাবে জরুরি সেবা দেওয়া না গেলেও স্থানীয়ভাবে অব্যবহৃত অর্থ সমন্বয়ের সুযোগ নেই। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কার এনে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে আর্থিকভাবে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। তারপরেও সীমিত বাজেটের ভিতরে অর্থ অপচয়ের জায়গা বন্ধ করে, একই কাজের পুনরাবৃত্তি রোধ করে, দুর্নীতি কমিয়ে ও দক্ষতা বাড়িয়ে বরাদ্দ অর্থের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের সুযোগ থাকে। বাজেটের ভেতরেই স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি মোকাবিলায় সামগ্রিক ও কৌশলগত মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ থাকতে হবে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার সরকারি অর্থায়ন পুরোপুরি সাধারণ কর ব্যবস্থা থেকে আসে। স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করার সক্ষমতা সরকারের খুবই কম, সবসময় তার অগ্রাধিকারে নানা মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়নের প্রলোভন। লুটেরা-মাফিয়া ও কালো টাকার মালিকদের সঙ্গে অশুভ আঁতাত, অদক্ষ কর-আদায় ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর কর্মকর্তার কারণে কর-আদায়ে বিশ্বে এক দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮-৯ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে কর প্রশাসনের আধুনিকায়ন, ডিজিটাইজেশন, কর আইনগুলোর সংস্কার ও কর কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। কর আদায়ে ফাঁকি, দুর্নীতি ও হয়রানি রোধ করতে হবে। তখন রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি পাবে, সরকারেরও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির সক্ষমতা তৈরি হবে।
সরকারের কাছে স্বাস্থ্য খাত যদি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত হয়, তাহলে তাকে অবশ্যই স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করতে হবে। আশা করছি সরকার আসন্ন বাজেটে গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করবে। সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে সেই বৃদ্ধি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে টেনে তোলার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল হবে। এই সীমিত সরকারি বাজেট-বরাদ্দের মধ্যে থেকে সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী, সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারক পদক্ষেপকে অগ্রাধিকারের সঙ্গে নির্বাচন করে বাস্তবায়নই হবে স্বাস্থ্য খাতের নেতৃত্বের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যে ক্ষেত্রগুলোতে অগ্রাধিকার দিতে হবে–
১. কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবার শক্ত ভিত গড়ে তুলতে হবে।
২. স্বয়ংসম্পূর্ণ জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নির্মাণ করতে হবে।
৩. স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতিটি কর্মকাণ্ড একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার:
আমাদের প্রতিশ্রুত সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে একটি শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী কৌশল। জরাজীর্ণ অবকাঠামো, জনবলের ঘাটতি, অদক্ষ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অপর্যাপ্ততায় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো ধুঁকছে। কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদানে তারা ভীষণভাবে অসক্ষম। কমিউনিটি ক্লিনিক কি সেবা দিবে, কতটুকু সেবা দিবে, কখন রেফার করবে তা খুবই সুনির্দিষ্টভাবে এলগোরিদম তৈরি করে অনুসরণ করতে হবে। যা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সহজেই দক্ষ করে তুলবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতি ১০০০০ জনে স্বাস্থ্যকর্মী প্রয়োজন ৪৪.৫ জন, বর্তমানে বাংলাদেশ তা আছে ৯.৯ জন।
আজ থেকে ৫০ বছর আগে চিহ্নিত হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই শাখা– স্বাস্থ্য বিভাগ ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা মাঠ পর্যায়ে একই রকম কাজে নিযুক্ত থাকেন। এই পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের ফলে সৃষ্ট পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাসের টানাপড়েনে বছরের পর বছর ধরে বিপুল শ্রমঘণ্টা ও সম্পদের অপচয় ঘটছে। গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত দুই অধিদফতর বিভক্ত ৭০ হাজার স্বাস্থ্যসেবা কর্মীকে একীভূত করে দায়িত্বের পুনর্বিন্যাস করলে শুধু অপচয় রোধ নয়, জনবল সংকটে ভোগা কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা দক্ষ হয়ে উঠবে। পাশাপাশি সমসংখ্যক এনজিও কর্মীও কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। তাদের পুনঃপ্রশিক্ষণ দিয়ে ও দায়িত্ব পুনর্বণ্টন করতে হবে যেন স্বাস্থ্যসেবায় তারা পরিপূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর, স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঠ পর্যায়ে ভিজিট এখন বহুলাংশেই অপ্রয়োজনীয় ও অপচয়মূলক কর্মকাণ্ড। তাদের কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহের সার্বক্ষণিক নিয়োগ করতে হবে এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা দেওয়ার সময়সীমা বৃদ্ধি করতে হবে। এখন সময় হয়েছে, কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহকে ট্রাস্ট থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করে স্বাস্থ্যসেবার মূলধারায় একীভূত করে অনুপ্রাণিত শক্তিতে রূপান্তর করার।
উপজেলা ও সাব সেন্টারভিত্তিক চিকিৎসকদের ছোট ছোট দল কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহের চিকিৎসাসেবা ও অন্যান্য স্বাস্থ্য কার্যক্রম একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং টেলিমেডিসিন ব্যবহার করে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখবে এবং রেফারেল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা জরুরি রোগীদের দ্রুত সময়ে স্থানান্তর ও স্থানান্তরিত রোগীদের সেকেন্ডারি লেবেলে সুষ্ঠু চিকিৎসা প্রাপ্তির সমন্বয় করবে। তথ্যপ্রযুক্তি ও আধুনিক পয়েন্ট অব কেয়ার সিস্টেমকে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের নগর প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ব্যাপক ঘাটতি ও গলদ বিদ্যমান। তা নিরসন করতে হবে। গ্রামীণ কমিউনিটি ক্লিনিকের আদলে গরিব ও সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা গড়ে তুলতে হবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকারের ওপরে ন্যস্ত দায়িত্ব তুলে নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে অর্পণ করতে হবে।
জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা:
কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে সফল হতে হলে তার রেফারেল পদ্ধতিকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো শক্তিশালী সেকেন্ডারি লেভেল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে তীব্র আর্থিক সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় নিয়ে আমরা কিছু সময়ের জন্য উপজেলাকে শক্তিশালী করার ধারণাকে স্থগিত রাখি। আমাদের সব শক্তি সংহত করে, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, পূর্ণাঙ্গ ও শক্তিশালী জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। তবে জেলা স্বাস্থ্য নেতৃত্ব ভৌগোলিক বিবেচনায় কোনও কোনও উপজেলাকে কার্যকর জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রাখতে পারে।
জেলা হাসপাতালকে সব বিশেষজ্ঞ ও পর্যায়ক্রমিকভাবে বিশেষায়িত সেবা প্রদানে সক্ষম হতে হবে। সব জরুরি চিকিৎসা, জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা (আইসিইউ, সিসিইউ, নিওনেটাল আইসিইউ) ও রোগ নির্ণয়ের আধুনিক ল্যাবরেটরি ও ইমেজিং পরীক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে। জেলা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিচালনায় আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দিতে হবে। স্থানীয়ভাবে নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামত ও তাৎক্ষণিক জনবল নিয়োগের আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাও থাকবে। তারা পুরো জেলার স্বাস্থ্য তথ্য, প্রশিক্ষণ, জনস্বাস্থ্যের পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণসহ জেলাভিত্তিক স্বনির্ভর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দেবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজ
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আনতে, দক্ষতা বৃদ্ধিতে, তথ্যের সন্নিবেশ ঘটাতে, তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা ও পরিকল্পনা তৈরি করতে, ব্যয়সাশ্রয়ী হতে, দুর্নীতি কমাতে সরকারের প্রয়োজন একটি জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজ (বা জাতীয় স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা)। একটি সমন্বিত, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম– যেখানে তথ্য ও প্রযুক্তি একীভূত হয়ে স্বাস্থ্যসেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এখন একটি ব্যাংকে সেবা নিতে গেলে সার্ভার ডাউন থাকলে অপেক্ষায় থাকতে হয়, তেমনি প্রয়োজন হলে সব স্বাস্থ্যসেবাকে অপেক্ষায় রেখে, সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এনআইডি-কে ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজ নির্মাণ করতে হবে। এই জাতীয় স্বাস্থ্য ডাটাবেজই বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে। কত দ্রুত সরকার একটি স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীবান্ধব পূর্ণাঙ্গ জাতীয় ডাটাবেজ প্রচলন করতে পারছে তা দিনশেষে (পাঁচ বছর শেষে) নির্ধারণ করে দেবে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের সাফল্য। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে স্মার্ট না করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে ওঠার সুযোগ নাই।
স্বাস্থ্যসেবা অর্থায়ন কৌশলপত্রে (২০১২-২০৩২) স্বাস্থ্য বাজেট জাতীয় বাজেটের ১৫ শতাংশে উন্নীত করা ও স্বাস্থ্যসেবা পেতে ২০৩২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (ওওপি) ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। বাস্তবে, ২০১২ সালে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ৬৪ শতাংশ ছিল, সেখান থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ৬৯ শতাংশে উঠেছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু বার্ষিক স্বাস্থ্য ব্যয় ৪৬ ডলার, যার ৬৯ শতাংশ এখন ব্যক্তির নিজস্ব। একটু বোঝার সুবিধার জন্য এখানে যুক্তরাজ্যকে তুলনায় আনি, সেখানে মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় ৪৫০০ ডলার, যার প্রায় পুরোটাই সরকার বহন করে।
সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে রোগীর পকেট থেকে অতি উচ্চ তাৎক্ষণিক ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। ব্যক্তির এই উচ্চ নিজস্ব ব্যয়ের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ওষুধে এবং ১২ শতাংশ রোগ নিরীক্ষায়। বাজেটের আগে প্রাপ্ত গত ছয় মাসে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের একটি সময়োপযোগী গ্রহণযোগ্য তালিকা স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হালনাগাদ করে মূল্য নির্ধারণ সমঝোতায় উপনীত হতে পারতো। স্বল্প মূল্যে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ প্রাপ্তির নিশ্চিত সাপ্লাই চেইন প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারতো। প্রতিটি জেলায় সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সার্বক্ষণিক (২৪/৭) মানসম্পন্ন সব জরুরি ও বিশেষ ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান চালু রাখতে বাধা কোথায়? এই দুটিই হতে পারে সবচেয়ে ব্যয়সাশ্রয়ী, সহজে বাস্তবায়নযোগ্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের যাত্রায় কার্যকর কৌশল।
বর্তমান নতুন সরকারের প্রথম ৬ মাস অতিক্রমের পথে। আর কয়েক দিনের মধ্যে নতুন অর্থবছরের বাজেট সংসদে উপস্থাপিত হতে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখনও কমিউনিটি হেলথ কেয়ার অথবা জেলা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ করার লক্ষ্যে কোনও বিনিয়োগ বা জনবল বৃদ্ধির পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য ডাটাবেজ নির্মাণের কোনও সংলাপও শুরু হয়নি কোথাও। বাজেট সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একটি বছর। এ বাজেটের মেয়াদকালে সরকার দেড় বছর অতিক্রম করে যাবে। আমরা কি আরও একটি পাঁচ বছরের সুযোগ হারানোর পথে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে নবজাতক, এক বছরের কম বয়সী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু- তিন ক্ষেত্রেই ২০২৩ সালে, পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় শিশুমৃত্যুর হার বেড়েছে।
সর্বোপরি, স্বাস্থ্যসেবা খাত নেতৃত্ব ও জাতীয় নেতৃত্বকে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণের পথ নিয়ে স্বচ্ছ ধারণার ভিত্তিতে ঐকমত্যে এসে লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সেই লক্ষ্য পূরণে অগ্রাধিকারের ক্রমানুসারে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি আবশ্যক। আর তা বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজন শক্তিশালী ও গতিশীল নেতৃত্ব।
একজন মানুষ শুধু আর্থিক অসামর্থ্যতার কারণে চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন, চিকিৎসা নিতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হবেন, চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছানোর আগে মৃত্যু হবে—লাখো মানুষের রক্তে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে তা কখনোই কাম্য হতে পারে না।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। কনসালটেন্ট, ল্যাবরেটরি মেডিসিন, এভার কেয়ার হাসপাতাল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিষয়ক কলামিস্ট।