বিপ্লব কুমার পাল
জন্মলগ্ন থেকেই ‘বোকাবাক্স’ বলে তকমা পেয়েছে টিভি। একসময় এর আকার ছিল বেঢপ! দেখলেই একটা বাক্সের কথা মনে হতো। আসলে সাদা চোখে টেলিভিশন দেখতে খুবই নিরীহ একটি যন্ত্র। একটা সময় এই বেঢপ বাক্সের অনুষ্ঠান নিয়ে উন্মাদনায় মেতেছিল বাঙালিরা। ৮০ দশকে ধারাবাহিক নাটক দেখার জন্য রাস্তা-ঘাট ফাঁকা থাকতো। ৯০ দশকে ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি ঠেকাতে রাস্তায় পর্যন্ত নেমেছিল দর্শক। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, পোস্টার। জনরোষ থেকে বাঁচতে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে রীতিমত আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে, ভাংচুর করা হয়েছে বাড়ি। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। একটি বোকাবাক্স কিভাবে বাঙালিদের উন্মাদনা করেছিল এমন শত শত নজির আছে বাংলাদেশে।
বেসরকারি টেলিভিশন আসার পর ঘটে গেলো আরেক বিপ্লব। সেই নতুনত্বের মধ্যেই টিভি তার জন্য নতুন দিগন্ত খুঁজে নিল। ছকভাঙ্গার নির্মাণ কৌশল আর দারুণ দারুণ আইডিয়া ভেসে ওঠতে শুরু করলো টিভির পর্দায়। নতুন অনুষ্ঠানের জোয়ারে ভেসে গেল সব ধরনের প্রজন্ম। এরপর শুরু হলো ক্যাবল যুগ। বাড়তে থাকলো চ্যানেলের সংখ্যা। কাজের সুযোগ হলো বহু মানুষের।
অতীতের সেই ‘বোকাবাক্স’ এখন আর ‘বোকা’ নেই। এক সময় বাক্সের জন্য আলমারি বানাতে হয়েছিল। সেই টিভি স্লিম ও স্মার্ট হয়ে এখন ঘরের দেয়ালে-দেয়ালে। প্রতিদিন বহু সময় চলে যায় ওই পর্দার দিকে তাকিয়ে। সেখানে তাকালেই দেখা যায় সারা দুনিয়ার সবকিছু। ঘটনা, বিনোদন, তর্ক আরও কতো কিছু। এক সময় শুধু দেখা ও শোনা যেতো। আর এখন সরাসরি কথা বলাও যায়। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা মানুষকে বুঁদ করে রাখার ক্ষমতা আছে টেলিভিশনের।
ইন্টারনেট এসে যাওয়ার পরে অনেকেই টিভিকে বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেছে, সেই ধারণা ভুল, টিভি আছে টিভির স্থানেই। আগের যুগের সেই ‘বোকাবাক্স’—আজ হয়ে গেছে এক ‘যাদুর বাক্স’! ১৯২৬ সালে আবিষ্কৃত এই যন্ত্রটি আর এক বছরের পর একশ বছর পূর্ণ করবে।
টেলিভিশনের এই এগিয়ে যাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে অনুমোদিত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল সংখ্যা ৪৫টি, এর মধ্যে সম্প্রচার রয়েছে ৩৫টি। এসব চ্যানেলে প্রচুর মানুষ কাজ করে। প্রচার হয় নানা ধরনের অনুষ্ঠান। কিন্তু দু-একটি অনুষ্ঠান, নাটক ছাড়া বেশিরভাগ দর্শকপ্রিয়তা পায়না। এনিয়ে একে অপরের দোষারোপ চলে। কেউ বলেন- এতো কম বাজেটে, ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব নয়। আবার মালিক পক্ষ বলে- অনুষ্ঠান বিক্রি করে খরচ তোলা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এতোদিন বিজ্ঞাপন প্রচারের আয় দিয়ে বেসরকারি টেলিভিশনগুলো চলেছে।
আর বিজ্ঞাপন দর নির্ধারণ হয় টিআরপি দিয়ে। টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টের (টিআরপি) মাধ্যমে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের দর নির্ধারিত হয়। টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয়তা অর্থাৎ দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা যাচাই করা হয়। আর জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের দর নির্ধারিত হয়। যে টেলিভিশন বা অনুষ্ঠানের টিআরপি বেশি সেসব চ্যানেলে বেশি বিজ্ঞাপন পায়। স্বাভাবিকভাবে এতে আয়টাও বেশি হয়। তাই টিআরপি বাড়াতে টিভি কর্তৃপক্ষ দক্ষ জনবল দিয়ে ভালো অনুষ্ঠান নির্মাণ করাতেন। টেলিভিশনে দক্ষ কর্মীদের কদরও বেশি ছিল।
২০১৮ সাল থেকে টিআরপি নির্ধারণের প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। যেসব চ্যালেল টিআরপির ওপরের দিকে থাকে তারা খুশি হলেও, অন্যরা এর নির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ করে ২০২০ সালের ২৩ জুন তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী জানান, টিআরপি নির্ধারণের জন্য সরকার অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তিনি বলেন, ‘এখন কে কাকে টিআরপি দেয়, সেটি আমাদের জানা নেই। টিআরপি যারা করছে তারা কোথা থেকে অনুমতি নিয়েছে, কে তাদের লাইসেন্স দিয়েছে- সেটি অনেকের প্রশ্ন।’
তখনকার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর কথায় পরিস্কার দেশে একটি বা দু’টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যারা টিআরপি নির্ধারণ করে তাদের প্রক্রিয়ায় অনেক নমুনা সংগ্রহের কথা বলা হতো। তবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি জানিয়েছে যে, ওই প্রতিষ্ঠান মাত্র ১৬৪ টি নমুনা সংগ্রহ করে সেখান থেকে টিআরপি দেয়। বাংলাদেশের জনসংখ্যার নিরিখে কমপক্ষে ১০ হাজার নমুনা চলমানভাবে নিয়ে কাজ করলেই প্রকৃত চিত্রটা পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তথ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, ভারতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার নমুনা ‘কন্টিনিউয়াসলি কালেকশন’ করা হয় এবং সেভাবেই টিআরপি দেয়া হয়।
২০২১ সালের ৪ এপ্রিল তথ্য ও সম্প্রচার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এতে বলা হয়, মানসম্মত, সুশৃঙ্খল ও প্রতিযোগিতামূলক প্রচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে টিআরপি নির্ধারণের প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, কারিগরি সহায়তা দেওয়া এবং কার্যক্রম তদারক করতে এই নিয়মাবলি ঠিক করা হয়েছে। ২০ এপ্রিল থেকে তা কার্যকর হবে। এরপর থেকে টিআরপি নির্ধারণ বন্ধ হয়ে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো- টিআরপি নির্ধারণ বন্ধ থাকলে এখন টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের দর নির্ধারিত হচ্ছে। আসলে সব শেষ টিআরপি দিয়ে টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের দর নির্ধারিত হয়ে আসছে। কোনো টেলিভিশন রেটিং- দুই নম্বরে ছিল, সেই দরে তারা বিজ্ঞাপন পেয়ে আসছে। ব্যাপারটা এমন যে, সেসময় টেলিভিশনের রেটিং পয়েন্ট দুই নম্বরে ছিল, তখন বছরে ৫০ লাখ টাকা বিজ্ঞাপন পেত। এখনও সেই টিভি ৫০ লাখ টাকারই বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। আগে তারা ভালো মানের অনুষ্ঠান প্রচার করতো। এখন হয়তো সেখানে চলচ্চিত্র প্রচার করছে সেটি বিবেচ্য হচ্ছে না।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের মার্কেটিং প্রধান বলছিলেন, অনেক টাকা খরচ করে ভালো মানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করে যে টাকার বিজ্ঞাপন পাওয়া যায়, সেই একই টাকা পাওয়া যায় ৫-১০ হাজার টাকায় কেনা চলচ্চিত্র প্রচার করে। এজন্য বেশিরভাগ টেলিভিশনে নিজস্ব অনুষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। দিনে ২/৩টি চলচ্চিত্র প্রচার করছে। এতে করে দুই থেকে লাভ। একদিকে অনুষ্ঠান নির্মাণের খরচ বাঁচলো, অন্যদিকে কম টাকা বেশি লাভ হলো।
অথচ একটা সময় টিআরপি নিয়ে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে উৎকণ্ঠায় থাকতো। তাই প্রতিটি অনুষ্ঠান নির্মাণে যত্ন থাকতে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই বাছাই করা হতো। অনুষ্ঠানে কেন দর্শক গ্রহণ করেনি তা পর্যালোচনা করা হতো। প্রয়োজন অভিজ্ঞ ও দক্ষদের এনে দায়িত্ব দেয়া হতো। কিন্তু এখন হয়েছে তার উল্টো। করিম ভালো কাজ করতো, সে করলেও ১০ টাকা আয়, রহিম কিছুই জানানা সেও করলেও ১০ টাকাই আয়। তাই করিম আর রহিমের কাজের মান এখন এক হয়ে গেছে।
টিআরপি আর বিজ্ঞাপনের এই গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ মানুষের ভাগ্য। কদরও কমে গেছে তাদের। কারণ ভালো কিছু কারার সুস্থ প্রতিযোগিতা নেই। সেটি হোক মিক্স চ্যানেল কিংবা সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন। তবে দুটি একটি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ এই স্রোতে গা ভাসায়নি।
দেরিতে হলেও আবার টিভি চ্যানেলের টিআরপি কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। গতে ৩ এপ্রিল টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট (টিআরপি) সেবার বাণিজ্যিক কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত। এসময় তিনি বলেন, সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড বিএসসিএল, টিআরপি সিস্টেম একটি বিজ্ঞান ও পরিসংখ্যানভিত্তিক মাধ্যম, যা টেলিভিশন চ্যানেল অথবা টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা নির্ণয়ের পাশাপাশি কোন এলাকায়, কখন, কতজন, কোন বয়সের মানুষ, নারী কিংবা পুরুষ কে, কতক্ষণ কোন চ্যানেলে কোন অনুষ্ঠান দেখেছেন তার সব তথ্য সংগ্রহ করে। এসব তথ্যাদি বিএসসিএল রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট সেবাগ্রহীতারা তথা টেলিভিশন চ্যানেল এবং বিজ্ঞাপন সংস্থা তা সরাসরি বিএসসিএল টিআরপি সিস্টেম সেবা থেকে গ্রহণ করতে পারবে। টিআরপি সেবা বাণিজ্যিকভাবে গ্রহণের জন্য বিএসসিএল সাথে বেশ কয়েকটি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ চুক্তিও করেছে।
শুরুতে বলেছে বোকাবাক্সটি এখন আর বোকা নেই। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে টেলিভিশন সেটের আধুনিক হেয়েছে। মোবাইল যুগে টেলিভিশন হারিয়ে যাবে- এমন শঙ্কার কথা বলা হলেও বড় দেশের সামগ্রিক ইলেকট্রনিকস পণ্যের বাজারের মতোই টেলিভিশনের বাজারও ক্রমবর্ধমান।
বাংলাদেশে টেলিভিশনশিল্পের ওপর গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে করা এক জরিপে বলা হয়, ২০২০ সালে টেলিভিশনের বাজারের আকার ছিল ৬৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৫ সালে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে মোট বিক্রীত ইলেকট্রনিকস পণ্যের মধ্যে টেলিভিশনের বাজারের আকার ৩০ দশমিক ০৩ শতাংশ।
আকাশ সংস্কৃতির এই যুগে, শুধু দেশেয় নয়, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বাংলাদেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান বিক্রি করে হাজার হাজার ডলার আয় করা সম্ভব। এরইমধ্যে দু’একটি টেলিভিশন তা প্রমাণও করেছে। এখন প্রয়োজন সুস্থ প্রতিযোগিতা আর নতুন নতুন আইডিয়ার সুনিপুণ নির্মাণ।
লেখক: গণমাধ্যকর্মী।