চাকরির শুরু এবং শেষ দু’টোই হোক আনন্দময়

পলাশ আহসান

সরকারি চাকরির বয়স ৩০ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন চলছে দীর্ঘদিন। এই দাবির সাথে একমত হয়ে সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী সুপারিশ করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। চাকরির এই বয়সসীমা নিয়ে নানা মত-দ্বিমত রয়েছে। নানা বিবেচনায় ঢোকার বয়স বাড়ানোর পক্ষেই যুক্তি বেশি। তবে সরকারি চাকরিতে ঢোকার মেয়াদ নিয়ে যত কথা হচ্ছে, অবসর নিয়ে কিন্তু এত কথা হচ্ছে না। যদিও দুটো বিষয় অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। তাই আলোচনা যেহেতু উঠেছে, সেহেতু দু’টো বিষয় নিয়ে এক সঙ্গেই আলোচনা হওয়া দরকার ছিল।  

এরইমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছেন চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে পর্যালোচনা হবে। কারণ এটা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। আমিও এই ‘পর্যালোচনা’ থেকেই লেখাটি শুরু করতে চাই। পাশাপাশি আমার আলোচনায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে চাই। সেটা হচ্ছে ‘বয়স নয়, যোগ্যতাই চাকরির প্রধান বিবেচ্য হওয়া উচিৎ’ তাই আসলেই চাকরির নীতিমালা নিয়ে এখন সুক্ষ্ম আলোচনা পর্যালোচনা হওয়া দরকার।

১৯৯১ সালে চাকরির বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে ৩০ বছর করা হয়। যখন গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। এখন গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে। তাই চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের মেয়াদ বাড়াতে নীতিগত কোন বাধা থাকার কথা নয়। কারণ আমরা বার বার বলছি জনশক্তিকে রাষ্ট্র শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। ২০ কোটি মানুষের দেশে জনশক্তিই প্রধান সম্পদ সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। আমার মনে হয় এই বয়স নির্ধারণের বিষয়টি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনারই অংশ।

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোয় কোনও সমস্যা দেখছেন না সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান ইকরাম আহমেদ। তিনি সেইসঙ্গে অবসরের বয়সও বাড়ানোরও পক্ষপাতি। গণমাধ্যমে তিনি বলেছেন, অনেকেই সময়মতো পড়ালেখা শেষ করতে পারে না। আবার সরকারি চাকরির পরীক্ষা জটিলতায় অনেকের বয়স বেশি হয়ে যায়। আবার কোনও চাকরিজীবী যদি সুস্থ থাকেন এবং বয়সের বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি অবসরে চলে যান, তখন তার অভিজ্ঞতা থেকে প্রতিষ্ঠান বঞ্চিত হয়।

আবার চাকরির বয়স বাড়ালেই কোন মানুষ চাকরি যোগাড় করে ফেলতে পারবেন তোমনটা নয় বলে মন্তব্য করেছেন, বেসকারি সংগঠন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, কেউ ৩০ বছরের মধ্যে চাকরি পেলে তারুণ্যের সুবিধা পান। প্রশিক্ষণসহ সব কাজে একটা গতি পান। বযস ৩৫ হলে তার কাজের আগ্রহ কমতে থাকে। যেকারণে তিনি, তারুণ্যের শক্তির অপচয় না করার পরামর্শ দিয়েছেন।

আমাদের সামনে যে পর্যালোচনার সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগে আমার মনে হয় বলা যায়, আমাদের চাকরিতে প্রবেশ এবং অবসরের বয়স হওয়া উচিত কাজের ধরণ অনুযায়ী। তারুণ্যের দুর্বার গতির প্রতি সবরকম আস্থা রেখেই বলছি অভিজ্ঞতার মূল্য্ও কম নয়। কারণ বাস্তবতা আমাদের প্রতিমুহূর্তে শেখায়। যিনি এক দিনের বড়, স্বাভাবকি নিয়মে তিনি একদিন বেশি শিখেছেন। যে শিখনের দাম বোঝা যায় প্রতি পদে পদে। তাই আমাদের এমন একটা পদ্ধতি দরকার যেখানে তারুণ্য এবং অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটানো যায়।

পাঠক চলেন আমরা দেখে নেই সাধারণ একজন সাধারণ মানুষের চাকরি জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। একজন শিক্ষার্থীর লেখাপড়া শেষ হয় ২৫ বছর বয়সে। তার সরকারি চাকরির বয়স থাকে ৩০ বছর পর্যন্ত। চাকরি শেষ করেন ৫৯ বছর বয়সে। আমরা বলতে পারি তার কর্মজীবনের মেয়াদ ২৫ থেকে ২৯ বছর। প্রায় একই সময়ে তাকে সংসার জীবনে ঢুকতে হয়। পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। বাবা হতে হয়। সন্তানরা বড় হতে হতে চাকরি শেষ। সংসারের দায়িত্ব কিছুটা হালকা হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি পান হয়তো, কিন্তু ভাবতে থাকেন তার প্রতিষ্ঠানকে আরও কিছু দেয়ার ছিল হয়তো।

কিন্তু আমাদের বর্তমান যে পদ্ধতি আছে, সেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির নামে কেউ অবসর নিলে ভাবা হয় যাক, আরেকজন কাজের সুযোগ পেলো। এজন্যে একসময় গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের নামে স্বেচ্ছা অবসর পদ্ধতিও চালু করা হয়েছিল। তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। কিন্ত এখনতো পরিস্থতি বদলেছে। স্বাস্থ্য অবকাঠামোর উন্নয়নে আমাদের গড় আয়ু ৭৩। নতুন করে ভাববার সময় নিশ্চয়ই এসেছে। অর্থনীতির নানা বাঁক বদলে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরী হচ্ছে। সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজের ক্ষেত্র বাড়ছে। নতুন একটা ছেলে বা মেয়ে যদি তার স্বাভাবিক গতিতে কাজ করতে পারে এবং সে যদি একজন প্রবীণের দিক নির্দেশনা পায় তাহলে নিশ্চয়ই কাজটি একটি নতুন মাত্রা পায়।

এবার আসি, চাকরিতে ঢোকার বয়স সীমার কাছে। এখন ঢোকার মেয়াদ আছে ৩০। দাবি করা হচ্ছে ৩৫। আমার ব্যক্তিগত মত চাকরিতে ঢোকার বয়সে কোন মেয়াদ থাকা উচিত না। এক্ষেত্রে যোগ্যতা হওয়া উচিত তিনি কর্মক্ষম বা সুস্থ কীনা। ধরা যাক, একজন মানুষ কোন একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তিনি সেই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন, কিন্তু চাকরি করেননি। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তিনি চাকরি করবেন কিম্বা সরকারিভাবে তার নিবিড় সহায়তা দরকার হলো। কিন্তু চাকরির বয়স নেই। এরকম মানুষের সহায়তা নিতে হলে তাকে কাজ দিতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিছু সম্মানী হয়তো দিতে পারে, কিন্তু নিয়মিত চাকরির সুবিধা দিতে পারে না।

আমার লেখা পড়ে যে কারো মনে হতে পারে, আমি জানি না চাকরির সুযোগ যতই বাড়ুক চাহিদা তুলনায় তা সবসময় সীমিত। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪-৫ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা শেষ করে চাকরির বাজারে আসে। যেখানে প্রতিবছর সরকারি চাকরিতে কর্মসংস্থান হয় ৪-৫ হাজার প্রার্থীর। এছাড়া সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে আরও ২-৩ হাজার কর্মসংস্থান হয়। এই বাস্তবাতাও আমাদের অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই নিয়মিত বিরতিতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নতুন ছেলেমেয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিরও দরকার রয়েছে। 

ভারতে সরকারি চাকরিতে আবেদনের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ থেকে ৪৫ বছর। কাতার, তাইওয়ান, ইতালিতে ৩৫ বছর। ফ্রান্সে ৪০ বছর। শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ায় ৪৫ বছর। সুইডেন ও কানাডায় ৪৭ বছর। আর যুক্তরাষ্ট্রে ৫৯ বছর। এই উদাহরণ দেখে আমরা বলতে পারি শুধু বয়স দিয়ে বিচার করে কর্মসংস্থান সমস্যার সমাধান করা যায় না।  আসলে দরকার প্রতিটি কর্মীর কাজের আনন্দ নিশ্চিত করা। সেই আনন্দ কর্মজীবনের শুরুতে যেমন দরকার শেষেও দরকার। সার্বিক বিবেচনায় একজন কর্মীর আসলেই যখন বিশ্রামের সময় হবে তখন তিনি যদি অবসরে যেতে পারেন, নিশ্চয়ই আনন্দ পাবেন। আর এই আনন্দ অনেকটাই নির্ভর করে তিনি কীভাবে কাজটি শুরু করেছিলেন তার ওপর। তাই আমার মনে হয়, চাকরির বয়স নিয়ে কোন গড় সিদ্ধান্তে না গিয়ে যদি কাজ অনুযায়ী বিবেচনায় আনা হয় তাহলেই পুরো বিষয়টি একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্যে আসবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি