নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সূচকগুলো ইতিবাচক ধারায় রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ সব মিলিয়ে অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে বলে ধারনা করছেন তারা। তবে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মুল্যস্ফীতিকে দুষছেন তারা। অন্যদিকে গত তিন মাসে প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। এছাড়া এপ্রিলে রেমিট্যান্স বেড়েছে ২১ শতাংশ। ঈদের ছুটির কারনে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানি আয় কমলেও চলতি মাসে সেটি বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টদের।
২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে দেশে ৩০২টি শিল্প ইউনিট থেকে ৩৩ হাজার ৮০৬ কোটি ২৯ লাখ টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এই সময়ে এই ৩০২টি শিল্প ইউনিট বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (বিডা) নিবন্ধিত। এর মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ১৭ হাজার ৬৩৬ কোটি ৯ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ১৬ হাজার ১৬৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ৩০২টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ২৭০টি দেশি, ১৮টি বিদেশি এবং ১৪টি যৌথ উদ্যোগে রয়েছে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের এই বিনিয়োগ প্রস্তাবের ফলে দেশে ৪ হাজার ৭৩৫টি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার মনে করেন, কৃষি খাতের উৎপাদন বেড়েছে। শিল্প খাতের উৎপাদন এখন ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগও আছে সঠিক পথে। অর্থনীতিতে এখন একমাত্র সমস্যা মূল্যস্ফীতি। তবে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে না পারাটাও একটি ইস্যু।
গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, ‘সরকারের বিনিয়োগ তেমন একটা কমেনি। সামাজিক খাতের বিনিয়োগ বিশেষ করে সুরক্ষা নীতিগুলোর পরিধি বেড়েছে। সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দিতেই এটি করা হয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের রাজস্ব ঘাটতি অত বেশি নয়। জিডিপির তুলনায় আমাদের রাজস্ব ঘাটতি এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্নদের একটি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করেছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারকে কোনো ধরনের ঋণ দেয়া হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের স্বার্থে আমাদের আমদানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হয়েছে। নিরুৎসাহিত করা হয়েছে কম গুরুত্বপূর্ণ ও বিলাসপণ্য আমদানিতে। পাঁচ মাস ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ছে। এ সময়ে প্রতি মাসে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। চার মাস ধরে সরকারের চলতি হিসাব ইতিবাচক ধারায় রয়েছে।’
গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়ে ২ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ঈদের কারণে এই বৃদ্ধি হলেও ব্যাংকারদের ধারনা, রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংক সরকারি হারের চেয়ে বেশি হারে অফার দেওয়া শুরু করায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে ১৯৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ঈদকে সামনে রেখে মাত্র দুই সপ্তাহে দেশের প্রবাসীরা প্রচুর রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, যা গত মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সহায়তা করেছে। রেমিট্যান্স আহরণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নমনীয়তা প্রবাহকে ত্বরান্বিত করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল ১ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার, যা ফেব্রুয়ারিতে ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার এবং জানুয়ারিতে ২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার ছিল। ব্যাংকাররা বলছেন, আগামী মাসগুলোতে প্রবাহ বাড়তে থাকবে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করে সরকারের স্বস্তির জায়গা করে দিবে।
এদিকে ঈদের কারনে রপ্তানি আয় কমে যাওয়াকে সংকট হিসেবে দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল মাসে রপ্তানি আয় এসেছে ৩ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই মাসে ছিল ৩ দশমিক ৯৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে এই মাসে আয় কমেছে ০.৯৯ শতাংশ, অর্থাৎ ১ শতাংশের নিচে। এ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক খাত ৪০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের ৩৮ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
পোশাক পণ্যের মধ্যে নিটওয়্যার রপ্তানিতে এসেছে ২২ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৭ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এটি ৯ দশমিক ১১ শতাংশ বেড়েছে। শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এপ্রিল মাসে ঈদ-উল-ফিতরের কারণে ১০-১২ দিন কারখানা বন্ধ ছিল। ফলে কম পণ্য উৎপাদন হয়েছে, কম কাজের আদেশ এসেছে ও অন্যান্য মাসের বিবেচনায় কম পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ব্যবসায়িদের মতে, ঈদের লম্বা ছুটির কারণে এটি একটি স্বাভাবিক সমস্যা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এপ্রিল মাসে ঈদের সময় শ্রমিকরা দীর্ঘ ছুটি ভোগ করায় কারখানার উৎপাদন কমে যায়। তবে সামগ্রিক আরএমজি রপ্তানি আদেশের পরিমাণ খারাপ নয়। আমি মনে করি আয় এই মে ঘুরে আসবে।