পলাশ আহসান
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে দুই নিরাপরাধ বাংলাদেশি হত্যায় প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কড়া প্রতিবাদ বেশ মনপূত হয়েছে দেশের মানুষের। কারণ সচেতন মানুষের সুর মিলেছে প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রতিবাদে। শেখ হাসিনা বলেন, একের পর এক বাংলাদেশি মারা যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু সেই অর্থে বিচার হচ্ছে না। একই রকম তথ্য দিচ্ছে দেশ বিদেশের পত্র পত্রিকার পরিসংখ্যান। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, এরকম কঠোর উচ্চারণ না করে তাঁর উপায় কী? কারণ সর্বোচ্চ মানবাধিকার রক্ষার সাইনবোর্ড সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে মানবাধিকার ভাঙছে, সেটা দেখাও স্নায়ুবিক অত্যাচার। আর তিনিতো একজন প্রধানমন্ত্রী। একটি দেশের অভিভাবক।
নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে ইউসুফ এবং বাবুলের মৃত্যুর আগে ১০ এপ্রিল মারা যান খসরু নামের আরেক বাংলাদেশি। এর আগে ১২ এপ্রিল মিশিগান রাজ্যের ওয়ারেন সিটিতে নিজের বাড়িতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান রাজি নামের এক যুবক। ২৭শে মার্চ নিউ ইয়র্কে নিজের বাসায় পুলিশের গুলিতে মারা যান রোজারিও নামে ১৯ বছর বয়সী একটা ছেলে। একটা বছরের প্রথম চার মাসে যদি একটি দেশেরই ৫ জনের এরকম মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত মৃত্যু হয়, তাহলে পুরো সেই দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, তা যে কেউ অনুমান করতে পারেন।
অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে অনেকে এগিয়ে। কম আয়ের দেশ হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর কিছুটা নির্ভর করে। তাই কখনও ইচ্ছায় আবার কখনও অনিচ্ছায় বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের নানা পরামর্শ নিতে হয়। সম্ভাবত পূর্বসূরীদের ধারাবাহিকতায়, শেখ হাসিনাকেও নিতে হয় সেই পরামর্শ। কখনও কখনও তাদের নানা কূটনৈতিক অসৌজন্যতাও সহ্য করতে হয়। সেই বিরক্তি শেখ হাসিনার কথায় পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে। কিন্তু এবারই প্রথম দেখা গেলো, তিনি এমন প্রকাশ্য বিরক্তির সুরে বলেলেন, তারা আয়নায় নিজের চেহারা দেখেন না।
কী সেই আয়না? কেনই বা তাদের দেখতে হবে? আয়না আর কিছু নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সারা বছরের মানবাধিকার চর্চার চিত্র। তাদের সেটা দেখতে হবে, কারণ তারা নিজেদের সারা বিশ্বের মানবাধিকার রক্ষার এজেন্ট দাবি করেন। এর পক্ষে রয়েছে তাদের নিজস্ব ঘোষণাপত্র। সেই ঘোষণাপত্রের প্রথম ধারায় আছে, প্রত্যেক মানুষের জীবন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অধিকার রক্ষা করা হবে। দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, সকল ব্যক্তি আইনের সামনে সমান। ঘোষণাপত্রের ১৮ টি ধারার পরতে পরতে আছে জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা।
অথচ তাদের দেশে ছোট বাচ্চারাও নিরাপদ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শিশু অনিরাপত্তার উদাহরণ হিসাবে ২০১২ সালে কানেটিকাট অঙ্গরাজ্যের স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর হামলায় ২০ শিশুর মৃত্যুর কথা বলা যায়। ২০২০ সালে তাদেরই গণমাধ্যমগুলো শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের অপ-মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে বন্দুকধারীদের হামলাকেই চিহ্নিত করে। অথচ মানবাধিকার রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রই সারাবিশ্বে সবচেয়ে সোচ্চার। নিজেরাই যেখানে মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, তারা কেন অন্যের মানবাধিকার রক্ষায় কথা বলে? কেউ যদি আরও প্রশ্ন করে এই মানবাধিকার রক্ষা করতে চাওয়ার পেছনের কারণ কী? কোন যুক্তিপূর্ণ উত্তর কি পাবেন তিনি?
সেই উত্তরের বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে, আরেকটু পরিস্কার হওয়া দরকার যুক্তরাষ্ট্রের একই অঙ্গে ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড সত্বা নিয়ে। শুরু করি বিচার বর্হিভূত হত্যা এবং আমাদের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ৭ কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে। ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। অথচ তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়াল্ডের হিসাবে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড হয় যুক্তরাষ্ট্রে। আর ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাবে, সেদেশে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রতিবছর এক হাজারের আশপাশে থাকে।
বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি আসলে বলতে চাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমাদের মানবাধিকার শিখতে হবে কেন? তারও চেয়ে বেশি বলতে চাই, আমাদের মানবাধিকার শেখাতে চাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য এজেন্ডা আছে। এটা অবশ্য নতুন কথা নয়। যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর থেকে দেখে আসি, দেখবো ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সেই বর্বর হত্যাযজ্ঞ তারা কখনই আমলে আনেনি। ১৯৭৫এ সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বিষয়টি মানবাধিকার লঙ্ঘন মনে করেনি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে, কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার বিষয়টিও।
আমরা যদি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আসি, সেখানেও দেখবো একই চিত্র। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার নিয়েও চিন্তিত ছিল। অথচ যুদ্ধের সময় যখন ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হলেন, দুই লাখ নারী বীরাঙ্গনা হলেন, শরণার্থী হলেন আরও এক কোটি, তখন তাদের মানবাধিকারের কথা মনে হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় অত্যাচারী পাকিস্তানের পক্ষেই ছিলো। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে জামায়াতে ইসলামীর মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।
এবার আসি গত মাসের ২৩ তারিখে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রসঙ্গে। তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিচারব্যবস্থা, সমাজ ও মানুষের প্রতি বিষেদগারে ভরা ছিল। সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ করা হয়। শ্রমনীতি, রোহিঙ্গা ইস্যু ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার গৃহবন্দিত্ব নিয়ে নিতিবাচক মন্তব্য বলে দেয় ওই প্রতিবেদন কতটা একচোখা। যে কেউই বলবে, এর প্রতিটি শব্দে শব্দে বসে আছে সেই তলা বিহীন ঝুড়ি তত্ত্বের হেনরি কিসিঞ্জার।
আজকের লেখাটি শেষ করবো, কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড এবং ফ্রাঙ্ক টাইসনকে হত্যার গল্প বলে। প্রথম জন অর্থাৎ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যা করা হয় ২০২০ সালে। দ্বিতীয়জনকে হত্যা করা হয় গত মাসে। দু’জনকেই ঘাড়ে হাঁটু চেপে ধরে হত্যা করে আলাদা দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা। এখানে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, দু’জনেই মৃত্যুর আগে বার বার বলছিলেন ‘দয়া করুন, আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না, আমাকে মারবেন না’। দয়া হয়নি পুলিশের। দু’টি হত্যাকাণ্ড দুই অঙ্গরাজ্যে। দুই ঘটনার মধ্যে চার বছররের পার্থক্য। অথচ অত্যাচারীর আচরণ এবং অত্যাচারিতের হাহাকারের ভাষা এক। তাহলে একটা বিষয় পরিস্কার, যুক্তরাষ্ট্র দিনের পর দিন একই রকম অনাচার করে যাচ্ছে। এখন একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, তাদের আচরণের ধরণ যেখানে পরিস্কার, সেখানে আর কতকাল অত্যাচারিতরা একই রকম হাহাকার করবে?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।