নীলফামারী, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও পাশাপাশি অবস্থিত তিনটি জেলা। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ ও খানসামা উপজেলার মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে আত্রাই নদীর। খানসামার আলোকঝাড়ী ইউনিয়নের জয়গঞ্জ ঘাটের পাড় দিয়ে নীলফামারী, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ের মানুষের পারাপারের একমাত্র ভরসা একটি নৌকা। প্রতিদিন নৌকা দিয়ে তিন জেলায় যাতায়াত করে হাজার হাজার মানুষ। যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা থাকায় বিভিন্ন পন্যসামগ্রী আনা-নেওয়া, মানুষের কর্মস্থলে যাওয়া আসা সহ প্রতিনিয়ত পড়তে হচ্ছে চরম দূর্ভোগে। বর্ষাকালে নদীর অথৈই পানিতে প্রতিনিয়ত ঘটে নানান ধরনের দূর্ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্ণা দিয়েও সেতু নির্মাণ না হওয়ায় প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগে পড়তে তিন জেলার লাখো মানুষকে। আর এই দুর্ভোগ এড়াতে চাইলে বাড়তি ঘুরতে হবে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেড়িয়ে গেলেও নির্মাণ হয় নি সেতু।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, ‘নদীর পশ্চিম দিকে অবস্থিত দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলা ও ঠাকুরগাঁও জেলা। আর পূর্ব দিকে নীলফামারী জেলা হয়ে যাওয়া যায় রংপুর বিভাগের আর ৫টি জেলা। প্রতিদিন হাজার মানুষ জয়গঞ্জ ঘাট দিয়ে নৌকায় করে নদীর এপার-ওপাড়ে তাদের গন্তব্যে যাতায়াত করে। নৌকা না থাকলে তাদের নীলফামারী, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও জেলা যাতায়াত করতে বাড়তি ৩০-৩৫ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হয়। রাতের আঁধারে কিংবা যানবাহন পারাপারে সমস্যা হলেও বাধ্য হয়ে ঝুকি নিয়ে দীর্ঘ পথ এড়িয়ে নৌকা দিয়ে যাতায়াত করছে মানুষেরা। জয়গঞ্জ ঘাটে একটি সেতু নির্মাণ করা হলে ৩ জেলার মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। এতে সহজ হয়ে উঠবে শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষিক্ষেত্রে বিপ¬ব ও বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের উন্নয়ন। অথচ একটি সেতু নির্মাণের অভাবে এলাকার লোকজন পিছিয়ে পড়ছে। কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না পরিবহন খরচ বেশি হওয়ার কারণে।’
স্বামীর বাড়ী খানসামার আলোকঝাড়ী থেকে বাবার বাড়ী ঠাকুগাঁওয়ে যাবেন শিউলি বেগম। এসময় তিনি বলেন,‘আধাঘন্টা ধরে নৌকার জন্য বসে আছি। নৌকা এপাড়ে আসলে নদী পার হয়ে ঠাকুরগাঁও যাবো বাবার বাড়ী। এদিক দিয়ে গেলে আমার বেশি সময় লাগবে না যেতে। সেতু থাকলে এতোক্ষনে বাবার বাড়ীতে গিয়ে বসে থাকতাম।’
ঠাকুরগাঁও থেকে নীলফামারী আসা আশরাফুল ইসলাম নামে এক মোটরসাইকেল আরোহী বলেন,‘বীরগঞ্জ দিয়ে নদী পাড় হয়ে নীলফামারী ঢুকতে আমার সময় লাগবে ১৫-২০ মিনিট। কিন্তু নদী পাড় না হয়ে যদি বিকল্প রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি তাহলে আমার সময় তো যাবেই উল্টো ২৫-৩০ কিলোমিটার বাড়তি পথ ঘুরতে হবে। তাই একটু কষ্ট হলেও ঝুকি নিয়ে নৌকা দিয়ে নদী পার হচ্ছি। তাই আমাদের দাবি অতি দ্রুত এখানে যেন একটি সেতু নির্মাণ করা হয়।’
জয়গঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা চাঁদ মিয়া বলেন,‘আমার জন্ম থেকে শুনতেছি এইখানে সেতু হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের এমপির কাছে একটি সেতুর জন্য কত আন্দোলন, কত মানববন্ধন করেছি আমরা। ভোট আসলে কয় সেতু তৈরি করে দিবে। কিন্তু ভোটের পর আর কারও কোনো খবর থাকে না। আওয়ামী লীগের পতন হয়ে গেলো কিন্তু সেতু হলো না।’
অপর এক বাসিন্দা বজলার রহমান বলেন,‘ কত বছর থেকে দেখছি। কত অফিসের লোকজন আসে দেখে আর মাপে। আর বলে যে সেতু হবে। কিন্তু সেতু আর হয় না। আওয়ামীলীগ সরকার তো সেতু করে দিতে পারলো না। অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের দাবি তারা যেনো জয়গঞ্জ ঘাটে একটা সেতু তৈরির ব্যবস্থা করে দেয়।’
জয়গঞ্জ-ঝাড়বাড়ী ঘাটের ইজারাদার ও সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘এই নৌকা দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার কৃষক, কর্মজীবী নারী-পুরুষ, শিক্ষার্থী ও সাধারণ যাত্রী পারাপার হয়। ঝুঁকি নিয়েই সাইকেল, মোটরসাইকেল, ভ্যান, অটোবাইক নৌকা দিয়ে পার হয়। রাতের আঁধারে নৌকা বন্ধ থাকে এসময় যাত্রীদের দীর্ঘ ৩০-৩৫ কিলোমিটার পথ ঘুরে যেতে হয় নদীর ওইপাড়।’
সেতু নির্মাণের বিষয়ে খানসামা উপজেলা প্রকৌশলী শাহ মো. ওবায়দুর রহমান বলেন,‘ওই খানে সেতু নির্মাণের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এজন্য ঢাকা থেকে আমাদের একটি ডিজাইন পাঠানো হয়েছিল। আমরা সেটি পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে আবারও ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোনো নির্দেশনা আসে নি আমাদের কাছে।’
অতিদ্রুত সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে নীলফামারী জেলা বিএনপির সভাপতি আ.খ.ম আলমগীর সরকার বলেন,‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার শুধুমাত্র অর্থ আত্মাসাৎ করেছে। বড় বড় প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। জনগণের জন্য তারা কিছুই করে নি। জয়গঞ্জ ঘাটের পাড়ে একটি সেতু নির্মাণ করা ছিল নীলফামারীবাসী সহ অন্যান্য জেলার মানুষের প্রাণের দাবি। হাজারো কৃষক তাদের পন্যসামগ্রী দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন করতে এবং তাদের সন্তানেরা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজে অধ্যায়রত আছে। তাদের যাতায়াতে সব সময় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয়। জয়গঞ্জ দিয়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও গেলে ৩০-৩৫ কিলোমিটার রাস্তা কম যেতে হয়। এখানে সেতু নির্মাণ করা হলে আমাদের আর বাড়তি রাস্তা ঘুড়ে যেতে হবে না। সময়, অর্থ ও শ্রম সবই বাঁচবে। তাই আমাদের দাবি অতি দ্রুত এখানে যেনো একটি সেতু নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।’