নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। তারপরও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’কোটাবিরোধী আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, কোটা ব্যবস্থার কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে।

কিন্তু সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা কোন পদ্ধতিতে কার্যকর হয়, তা নিয়ে অনেকেরই নেই ধারণা। জাতীয় কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পক্ষ থেকে কখনও কীভাবে কোন কোটা থেকে কতজন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে, সেই তথ্য স্পষ্ট না করায় জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন।

দেখে নেওয়া যাক, কোটা ব্যবস্থা কার্যকর হতো কোন পদ্ধতিতে।

যেভাবে নিয়োগ হয়

বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে পিএসসি প্রথমেই খালি পদগুলোকে মেধা ও কোটা এই দুই ক্যাটাগরিতে ভাগ করে নেয়। বিষয়টি বোঝা সহজ হবে গাণিতিক হিসাবে। উদাহরণ হিসেবে ধরে নেওয়া যাক, প্রশাসন বা আ্যডমিন ক্যাডারে ১০০ খালি পদ আছে। এর মধ্যে প্রথমেই ৪৫ জনের নিয়োগ দেওয়া হয় মেধাক্রম অনুযায়ী। বাকি ৫৫ জনকে নেওয়া হবে বিভিন্ন কোটার মাধ্যমে।

পিএসসি তার সিস্টেমে প্রথমে সবগুলো (লিখিত+মৌখিক) নম্বর ইনপুট দেয়। এরপর সিস্টেমের অ্যালগরিদম প্রথমে পাস করা প্রার্থীদেরকে তাদের নম্বর অনুযায়ী বাছাই করে ফেলে এবং ফেল করা প্রার্থীদের ডেটাবেইজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। অর্থাৎ পরীক্ষায় (লিখিত+মৌখিক) পাস না করলে কোটা ব্যবস্থায় প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই।

এরপর পাস করা প্রার্থীদের ডেটাবেইজ থেকে সিস্টেম যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা ৩০ জন, নারী ১০ জন, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ জন ও সবশেষে সাধারণ জেলা কোটার ১০ জনকে নিয়োগ নিশ্চিত করে।

এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হলো- জেলা কোটা মূলত সবার কোটা। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীই এর আওতায় পড়েন। জেলার জনসংখ্যার শতকরা হারের উপর নির্ভর করে দেওয়া হয় এই কোটা।

প্রত্যেক জেলার জন্য নির্ধারিত থাকে কতজন নিয়োগ হবে এখান থেকে। কিন্তু যদি এই কোটা প্রয়োগের আগেই কোনও এক জেলা থেকে যথেষ্ট সংখ্যক নিয়োগ হয়ে যায়, তাহলে আর ওই জেলার কোটা কাজে আসবে না। আর যদি শেষ পর্যন্ত দেখা যায় জেলা কোটা খালি থাকে, তাহলে পুনরায় মেধাক্রম থেকেই নিয়োগ দেওয়া হবে খালি থাকা পদগুলোতে।

শেষে যদি দেখা যায় সব কোটায় নিয়োগের পরও কোটার জন্য সংরক্ষিত কিছু পদ খালি আছে, তখনই আসে প্রতিবন্ধী কোটা। উত্তীর্ণদের মধ্যে কে প্রতিবন্ধী, তা খোঁজা হয়। যদি কাউকে পাওয়া যায় তখনই ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী কোটা প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া কোটার প্রসঙ্গে বলেন, “নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রথমে মেধাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তারপর কোটা প্রয়োগ হয়। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, প্রধান কিন্তু জেলা কোটা। এটার ভেতরেই সব কোটা। কারণ, এই কোটায় সবাই পড়ে। বিসিএসের বাইরে অন্য পরীক্ষায় কিছু বাইরের কোটা থাকে। কিন্তু বিসিএসে ব্যবস্থাপনা এরকমই।”

সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তালিকায় প্রতিবন্ধী পাওয়া যায় না, তাই এই কোটা পরবর্তীকালে পাওয়ার সাপেক্ষে ব্যবহার করা হয় বলে জানান তিনি।

বিসিএস পরীক্ষার বাইরে বাকি পরীক্ষাগুলোতে আরও কিছু কোটা রয়েছে। এর মধ্যে এতিম কোটা, পোষ্য কোটা গুরুত্বপূর্ণ।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রাধান্য পায়?

২০১৮ সালের আন্দোলনের মতো এবারের আন্দোলনকারীরাও মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ অযৌক্তিক। তাছাড়া কোটা প্রয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এমন অভিযোগও রয়েছে আন্দোলনকারীদের।

বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, “গাণিতিক কারণে মাঝে মাঝে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধা কোটা সব জায়গায় প্রয়োগ হয়। যেমন ধরুন, যদি কোথায় ৫ জনকে নিয়োগ করা হয়। তাহলে নারী কোটা ১০ শতাংশ প্রয়োগ করলে সংখ্যাটি দাঁড়ায় শূন্য দশমিক পাঁচ। এটা তো কাউন্ট করা যায় না। আবার মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ প্রয়োগ করলে সংখ্যা হয় ১ দশমিক ৫। তখন এই ফ্র্যাকশনটা বাদ দিয়ে ১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।”

কোটার কারণে পদ ফাঁকা থাকে?

বিভিন্ন মহল থেকে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, সরকারি চাকরিতে প্রচুর শূন্য পদ রয়েছে এবং শূন্য পদগুলোর বেশিরভাগই কোটার পদ। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে অনুমোদিত পদ আছে ১৯ লাখ ১৫১টি। এর মধ্যে শূন্য আছে ৩ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৭টি।

কোটার কারণেই পদ শূন্য কি না- প্রশ্নে সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলছেন, “এক সময় এই সমস্যা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হয়, যা ফাঁকা থাকবে, তা সব মেধাক্রমে চলে যাবে। শেষ অনেকগুলো নিয়োগই এই নিয়মে হয়েছে। ফলে, এখন এই কারণে এই সমস্যা হচ্ছে না। কোটার জন্য পদ ফাঁকা এটা এক সময় সত্য ছিল, কিন্তু এখনকার অবস্থায় তা সত্য না।”

২০১৮ সালের আগে কোটার প্রচুর পদ খালি থাকার নজির আছে। কিন্তু ২০১৮ সালেই মার্চ মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, সব ধরনের সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটার কোনও পদ যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পূরণ করা না গেলে সেগুলো মেধাতালিকার শীর্ষে থাকা প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি