আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

পলাশ আহসান

গোপাল ভাড়ের গল্প বলে আজকের লেখাটা শুরু করি। একদিন গোপালের মেয়ে নদীতে পানি আনতে যাচ্ছে। তার কাঁখে মাটির কলসি। গোপাল মেয়েকে ডাকলেন এবং কষে একটা চড় দিলেন। মেয়ে হতভম্ব। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো- আমাকে যে মারলে, আমার অপরাধ কী? গোপাল বললেন, পানি যে আনতে যাচ্ছিস, কলসিটা যদি ভেঙে যায়। মেয়ে বললো ভাঙেনিতো। গোপাল বললেন, কলস ভাঙার পর আর থাপ্পড় দিয়ে লাভ কী? তাতে তো ভাঙা কলস আস্ত হবে না।

গোপালের সেই ঘটনার পর মেয়ে কী বলেছিল তা গল্পে ছিল না। একইভাবে এবার আমাদের কোটা আন্দোলনের বন্ধুরা আদালতের রায় পাওয়ার আগে যখন রায়ে কী আসা দরকার সেই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন, তখন সরকার পক্ষ থেকেও সেরকম উচ্চবাচ্চ হয়নি। গণমাধ্যমগুলো তাদের কথা ঠিকঠাক প্রচার করেছে। কারণ সবাই বোঝে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কখনো এত হিসাব করে হয় না। আদালতে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলা যে আদালত অবমাননার শামিল, সেই জটিলতাও তাদের মাথায় আসার কথা নয়। যে কারণে সবাই মোটামুটি ক্ষমা সুন্দর মুডেই ছিল।

ব্যক্তিগত আমার সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে তাদের ব্যানার। ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ । অনেক বড় কথা। সন্দেহ নেই এটা সময়ের দাবি। আমি বলবো কোটার আন্দোলন এখন উন্নীত হলো বৈষম্য বিরোধিতায়। সেটা এলো ছাত্রদের মধ্য থেকে। এর চেয়ে আশাব্যাঞ্জক আর কী হতে পারে? অন্যান্য যেকোনো আন্দোলন এবং এবারের এই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পার্থক্য খুঁজতে গিয়ে সরকারের আচরণের ফারাকটাই সবার আগে চোখে পড়লো। এবার সরকারও যা চায় আন্দোলনকারীরাও তাই চায়। যদিও এর মধ্যে অনেকে ষড়যন্ত্র তত্ব খুঁজছেন ।

আজকের আন্দোলন বৈষম্য বিরোধী। কোট পদ্ধতিও এসেছে বৈষম্য দূর করার কারণে। সারা পৃথিবীতে কোটা রাখা হয় একই কারণে। কেন কোথায় কী কারণে কোটা সুবিধা রাখতে হবে সেটা নিয়ে প্রথমত বিস্তর গবেষণা হয়। তার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আরেকটি কথা সবার জানা থাকা দরকার। কোটা কখনই স্থায়ী হয় না। পরিকল্পনার সময়ই ঠিক করা হয় এই সুবিধা কতদিন থাকবে। আজকের বাংলাদেশেও কোটা পদ্ধতি এসেছিল বৈষম্য দূর করার জন্যেই। যেকারণে সংবিধান দিয়ে এই পদ্ধতির সুরক্ষাও দেয়া হয়েছিল।

২০১৮ সালের আন্দোলনকারীদের অনমনীয়তা এবং কোন আলোচনা করতে না চাওয়ার কারণে সরকার সব কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল। ভুলটা আসলে ওই সময়ের। যেকোন সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্যে গবেষণা দরকার, তার জন্যে সময় দরকার। পরিস্কার তথ্য থাকা দরকার পক্ষ বিপক্ষের হাতে। যারা কোন খাতে কোটা রাখতে চান, কেন রাখতে চান সেই তথ্যটি তাদের কাছে যেমন থাকা দরকার, তেমনি যারা এর বিরোধিতা করছেন, কেন করছেন সেই তথ্যটি তাদের কাছেও থাকা দরকার। কারণ দুই তথ্য সামনে আনলে, আসলে কোন দাবিটি সত্য, তা পরিস্কার হবে। 

২০১৮ সালে সেই প্রক্রিয়ায় যেতে চাননি আন্দোলনকারীরা। সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তাতে কী ভাল কিছু হয়েছে? বিশেষ বিসিএস ছাড়া অন্য বিসিএসে নারীদের নিয়োগের হার আগের চেয়ে কমে গেছে। কোটা বাতিলের আগের সাধারণ ৩৮-তম বিসিএসে প্রায় ২৭ শতাংশ নারী নিয়োগ পেলেও কোটা বাতিলের পর সাধারণ ৪০ ও ৪১ তম বিসিএসে নারীদের নিয়োগের হার ১-২ শতাংশ কমে গেছে। কোটা বাতিলের আগে ৩৮তম বিসিএসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ২১ জন সরকারি চাকরি পান। কোটা বাতিলের পর ৪০ ও ৪১তম বিসিএসে মাত্র একজন করে সুপারিশ পেয়েছেন। জনসংখ্যার ৬.৬৮ শতাংশ সিলেট বিভাগের হলেও ৪৩-তম বিসিএসে মাত্র ২.৩১ শতাংশ নিয়োগ পেয়েছেন।

এতো গেলো চোখের সামনের তথ্য। সবসময় দৃষ্টিতে আসে না এমন তথ্যও আসতে পারে কিছু প্রশ্নের উত্তর পেলে। যেমন ভৌগলিক অবস্থানের কারণে আমার দেশের সব সুবিধা কি সমানভাবে বণ্টিত? আমার দেশের অনগ্রসর শ্রেণির ছেলে মেয়েরা কী সামনে আসতে পারলো? আমার দেশের সব মেয়েরা কী পারলো উচ্চ শিক্ষা নিতে? ৫৬ ভাগ কোটার কথা বলা হচ্ছে গাল ভরে। একবারও কী ৫৬ ভাগ কোটা বাস্তবায়ন করা গেছে?

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আসতে পারে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের কোটা সুবিধা নিয়ে। দিনের পর দিন কত মুক্তিযোদ্ধা শুধু মুক্তিযুদ্ধ করার কারণে বঞ্চিত হলেন, তাদের কোন হিসাব কী আমাদের কাছে আছে? সেই সব বঞ্চিত পরিবারগুলো কি মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারলো শেষ পর্যন্ত? তারাতো রাষ্ট্রের দুর্দিনে রাষ্ট্রের পাশে ছিল কিছু না ভেবেই, তাদের কী সুবিধা দিতে পারলো রাষ্ট্র? যাদের সুবিধা দেয়া নিয়ে আজ এত স্লোগান দেয়া হচ্ছে তাদের নিয়ে কোন গবেষণা কী করেছি আমরা? মাঝে মধ্যে গণমাধ্যমে দেখা যেতো মুক্তিযোদ্ধার অমানবিক জীবন যাপনের গল্প। কেউ কী খবর নিয়েছি সেই সব গল্পগুলো মানবিক হয়েছে কী না।

আমার মনে হয় এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সবার সামনে পরিস্কার থাকলে আজকের এই আন্দোলনের দরকারই হতো না। আজ যারা কোটা নিয়ে অভিযোগ করছেন, কেউ কী কোন গবেষণা পত্র দিয়ে বলতে পেরেছেন এই সময় পর্যন্ত এত জন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ছিল এখন আর একজনও নেই। তাই মুক্তিযোদ্ধা কোটা দরকার নেই। সে কথা কেউ বলতে পারেননি অথবা বলেননি। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনের দিকে যদি আমরা তাকাই, কী দেখবো। তখনও দাবিগুলো যুক্তি আকারে আলোচনার টেবিলে আসেনি।  সামনে এসেছিল কিছু দাবি এবং উত্তাল আন্দোলন। পরে আমরা কী দেখেছি সেই আন্দোলনের নেতারা একের পর এক নানা  বিতর্কে জড়িয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা এই আন্দোলনের প্রধান হিসাবে যাকে সবাই চিনতো তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী চক্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ এসেছে। একজন সমালোচিত মানুষ যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় সেই আন্দোলন নিয়ে নানা প্রশ্নতো আসতেই পারে। তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেন আলোচনার পথ ধরে সমাধানে যেতে চাননি সে প্রশ্নও আসতে পারে বড় করে। যদিও আমি এই লেখায় সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না। আপাতত বলছি, রাষ্ট্রের বৈষম্য সম্পর্কে ঠিকঠাক তথ্য না থাকায় সত্যিকার অর্থে আজকের বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন পুরোপুরি বৈষম্য বিরোধী হয়ে উঠছে না।

আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য আছে সন্দেহ নেই। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে ৩০ ভাগ কোটা দেয়ার দরকার বা বাস্তবতাও হয়তো নেই। তাই এই আন্দোলনের যৌক্তিকতাও আমি অস্বীকার করি না। তাছাড়া যে কোন যৌক্তিক দাবি আদায়ে প্রেসার গ্রুপ যেকোন গণতান্ত্রিক দেশে খুবই স্বীকৃত। প্রেসার গ্রুপ তার দাবি নিয়ে সরকারের কাছে যাবে। সরকার তার পক্ষ থেকে বলবে। প্রয়োজনে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে সরে আসবে। এনিয়ে, কেউ একগুয়ে মনোভাব দেখাবে না। এর মধ্যে থেকেই একটা সত্য প্রতিষ্ঠা হবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

কিন্তু বুধবার আদালতের ব্যাখ্যার পর সন্ধ্যায় আন্দালনকারীরা যে অবস্থান নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে এবারের আন্দোলনও গতবারের পথে হাঁটছে। উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগ যখন বলে দিয়েছে এই মুহূর্তে ২০১৮ এর পরিপত্র বহাল থাকছে। তাই এখন সব প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরেতে হবে। তবে আদালতের এই আদেশের পর আন্দোলনকারীরা বলছেন, তাঁরা সরকারের কাছে সমাধান চান এবং সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে থাকবেন। পাশাপাশি আবারও জনদুর্ভগের ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা দেন।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ সরকারও এই সমস্যার একটা যৌক্তিক সমাধান চায়। যেহেতু বিষয়টি আদালতে গড়িয়েছে সেহেতু সরকার আদালত অবমাননা করতে চায় না। পদ্ধতিগতভাবে সেই সুযোগও নেই। তাছাড়া সমস্যাটা তো নাগরিকের। কোন নাগরিক যদি মনে করেন তিনি নির্বাহী বিভাগের কাছে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না, তিনি আদালতের কাছে যেতেই পারেন। বিচার বিভাগের যেকোন সিদ্ধান্ত তো নির্বাহী বিভাগকে দিতেই পারেন। এখানে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের ধুয়ো তুললে শুধু জটিলতা তৈরি করা হবে। সমস্যার সমাধান হবে না।

আগেই বলেছি সমস্যাটা যখন সমাজের তখন সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ধীরে সুস্থে। তাই আমার মনে হয় সময় নিচ্ছে আদালত। ভাল কিছুর জন্য সময়তো দেয়াই যায়। সেখানে বারবার বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা চাইলে আদালতের কাছে তাদের যেকোন দাবি তুলতে পারবেন, মতামত দিতে পারবেন। সেখানে তো কোন কথাই থাকার কথা নয়। শেষমেষ সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে আন্দোলনের পথ তো খোলাই থাকছে। এসময় সমাধানের পথে না হেঁটে হটকারিতার পথে হাঁটলে আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়েই তো প্রশ্ন উঠবে।

তাছাড়া যে আন্দোলন দেশময় ছড়িয়েছে, টানা সেই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতো আছেই। কারণ এবার প্রথম থেকে দেখছি আন্দোলনটি অহিংস চরিত্র ধরে রেখেছে। কিন্তু যেকোন মুহূর্তে আন্দোলনের মধ্যেই যে একটা নাশকতা হবে না সেই নিশ্চয়তা কেউ কী দিতে পারেন? সহিংসতার হাজারটা কৌশল যেখানে আমাদের পরিচিত সেখানে কে নেবেন এই অপকৌশলের দায়? আমরা জানি প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রে যেকোন অপ্রতীতির দায় সরকারের। তাই এখানে সরকার কি এই ঝুঁকি নিতে চাইবে? যেমনটা চায়নি ২০১৮তে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।

  • Related Posts

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    প্রভাষ আমিন চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে একটা দারুণ বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কার বিরুদ্ধে আন্দোলন, কেন আন্দোলন, দাবি কার কাছে- এসব ঠিক পরিষ্কার নয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালে এক প্রজ্ঞাপন…

    Continue reading
    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    নিজস্ব প্রতিবেদক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে রবিবার (১৪ জুলাই) চীন সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, সরকারি চাকরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিরা কোটা সুবিধা পাবে না, তাহলে কি…

    Continue reading

    Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *

    মুক্ত মতামত

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    বিভ্রান্তিকর ও স্বার্থপরতার আন্দোলন!

    ‘রাজাকার’ ইস্যু বানিয়ে একই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি

    প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বিকৃত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    আজকের আন্দোলনকারীরা কি ২০১৮ এর ভুলটিই করবেন?

    নিয়োগ পরীক্ষায় পাস না করেও কি কোটা ব্যবস্থায় চাকরি পাওয়া যায়?

    কোটা পুনর্বহালে স্থিতাবস্থা মানে কি?

    প্রধানমন্ত্রীর সফরে পাঁচ মূলনীতির উন্নয়ন করতে চায় চীন

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা ভাবা যেতে পারে

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি: বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনুঘটক

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি

    ভারত-বাংলাদেশ সামরিক চুক্তির লাভ-ক্ষতি