নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ। কোটা বাতিলের দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভের মধ্যে বুধবার সরকার এবং আন্দোলনকারী দুই শিক্ষার্থীর আবেদনে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ স্থিতাবস্থা জারির এই আদেশ দেয়।
আদেশ দেওয়ার সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, “স্ট্যাটাস কো মানে হলো স্থিতাবস্থা, সবাই আপনারা তা জানেন। অর্থাৎ এটা নিয়ে আর কোনও কথা হবে না।”
সর্বোচ্চ আদালত এক মাসের জন্য এই স্থিতাবস্থা দিয়েছে। এর মধ্যে হাইকোর্টের রায়ে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে নিয়মিত আপিলের আবেদন করতে হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেন, “লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) না আসা পর্যন্ত যার যার কাজে ফিরে যান।”
সাধারণ অর্থে স্থিতাবস্থা মানে হলো, যা আছে আগের মতো থাকবে।
তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, কোটা বাতিলে ২০১৮ সালে জারি করা সরকারের পরিপত্র জারির অবস্থা বহাল থাকবে? না কি তা বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে।
এই মামলায় এখন তিনটি পক্ষ। একটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে যারা রিট আবেদন করেছিলেন। যে আবেদনে হাইকোর্টের রায়টি হয়েছে।
একটি পক্ষ সরকার, যারা হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করেছে। অন্য পক্ষ হচ্ছে আন্দোলনকারী দুই শিক্ষার্থী, যারা এই মামলায় পক্ষভুক্ত হয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিতে আবেদন করেন।
এই দুই পক্ষের আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ থেকে স্থিতাবস্থা জারির আদেশ আসে।
আদেশের পর মূল রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী বলে যে আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিলেও হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেনি।
তবে আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “উভয় পক্ষকে শুনানি করে আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। অর্থাৎ যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে। অর্থাৎ চাকুরি যেগুলো চলমান আছে, সেগুলো সবই ঠিক থাকবে।”
কোটা থাকছে কি থাকছে না- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এখন যেহেতু স্থিতাবস্থা আছে, যেগুলো ছিল, সবগুলো থাকবে।”
কোটার প্রকৃত অবস্থা কী হলো এখন- এই প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই থাকবে।
“স্থিতাবস্থা দেওয়া হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাটারে। সাবজেক্ট ম্যাটারে এটা বাতিল করা ছিল। যে বিজ্ঞপ্তিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে কোটা পদ্ধতি লাগবে না। নতুন করে কোনও বিজ্ঞপ্তি দিতে হলে, এখন আপাতত কিছু করবে না। মামলাটা আগামী ৭ আগস্ট শুনানি হবে, তখন ঠিক করবে এটা।”
আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী। তিনি শুনানিতে বলেছিলেন, আপিলের আবেদন দায়ের না হওয়া পর্যন্ত যেন হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে।
তবে আপিল বিভাগ সেই আবেদনে যেমন সাড়া দেয়নি, আবার হাইকোর্টের রায় স্থগিতও করেনি।
অপেক্ষা পরবর্তী আদেশের
২০১৮ সালে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। এরমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী কোটা ১ শতাংশ।
কোটার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে- এই দাবি তুলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ২০১৮ সালে কোটা বাতিল করে সরকার।
তার প্রতিক্রিয়ায় ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল’ এর সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে।
সেই আবেদনে গত ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায় দেয়।
ওই রায় স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির কাছে গিয়েছিল রাষ্ট্রপক্ষ। তবে চেম্বার আদালত গত ৯ জুন সেই আবেদন পেয়ে তা শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়।
গত ৪ জুলাই আপিল বিভাগে মামলাটি ওঠে। তবে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করে রাষ্ট্রপক্ষকে নিয়মিত আপিলের আবেদন করতে বলে।
এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী মঙ্গলবার এই মামলায় পক্ষভুক্ত হতে আবেদন করে, তাতে হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আরজি জানানো হয়। আবেদনকারীরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আল সাদী ভুইয়া ও উর্দু বিভাগের শিক্ষার্থী আহনাফ সাঈদ খান।
রায় স্থগিতে দুই পক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়েই বুধবার আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা জারির আদেশ দিল।
এই পুরো প্রক্রিয়া তুলে ধরে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, “নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ছিল। সেটা ২০১৮ সালে সরকার একটি কমিটি করে প্রথম ও দ্বতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে বাতিল করে দেয়। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকুরির ক্ষেত্রে সেটা বহাল থাকে।
“পরবর্তীতে এটা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ হাই কোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি যেটা আগে ছিল, সেটাই আবার বহাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে এ রায়টি চ্যালেঞ্জ করে আমরা আপিল বিভাগে একটি আবেদন করি। যেহেতু রায়ের অনুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই আমরা সিএমপি ফাইল করেছিলাম। সেই আবেদনের আজকে শুনানি হলো।”
তিনি বলেন, “আমরা কোর্টকে বললাম, এখনও রায়ের অনুলিপি পাইনি। রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। যেহেতু গত ৫ বছর ধরে কোটা পদ্ধতিটা বিলুপ্ত ছিল। সেই ক্ষেত্রে নতুন করে রায় না পাওয়া পর্যন্ত হাই কোর্টের রায়ের ওপর আমরা স্থগিতাদেশ চেয়েছিলাম। উভয়পক্ষকে শুনানি করে আপিল বিভাগ স্থিতাবস্থা দিয়েছেন।”
আদেশের সময় প্রধান বিচারপতিও বলেন, রাজপথে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারে। আদালত মূল আবেদনটি নিষ্পত্তির সময় তাদের বক্তব্য বিবেচনায় নেবে।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, “আমাদের ক্ষমতা আছে। আমরা হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করে দিতে পারি। সরকারকে ডিরেকশন দিতে পারি। ইউ ডু ইট, ডোন্ট ডু ইট- দুটোই বলতে পারি।
“আবার বলতে পারি, হাই কোর্টের রায়টি ঠিক হয়েছে; বলতে পারি রায়টি ঠিক হয়নি। কোনটা বলবো, রায়টি আমাদের সামনে না আসা পর্যন্ত বলতে পারছি না।”
আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে অ্যাটর্নি জেনারেলও বলেন, “সুপ্রিম কোর্ট এটা বিবেচনায় নিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টের আদেশেও আছে আন্দোলনকারীদের কোনও বক্তব্য থাকলে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল বিভাগে দিতে পারবে।
“তাই এখন আর (আন্দোলনের) যৌক্তিক কোনও কারণ নেই। এখন উচিৎ এটা বন্ধ করে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়া।”
এদিকে আপিল বিভাগের আদেশের প্রতিক্রিয়ায় আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম বলেছেন, আদালতের সিদ্ধান্ত তারা ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছে। তবে তাদের দাবি সরকারের কাছে। আর তাহলো কোটা সংস্কার করতে হবে।