নিজস্ব প্রতিবেদক
পৃথিবীর ৪৩টি দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের মাধ্যমে শান্তিরক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ৩৭ বছর ধরে প্রায় ৬৩টি মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ নিজেদের মেধা ও দক্ষতার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তিরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। বিগত বেশ কয়েকবছর ধরে এই শান্তিরক্ষীদের নিয়ে চলছে নানা অপপ্রচার। তারপরও কমেনি বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর কদর। শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সেসব অপপ্রচারে কখনই গুরুত্ব দেয়নি আন্তর্জাতিক কোন মিডিয়া। শুধু সুনির্দিষ্ট সংবাদ মাধ্যম এবং একজন সাংবাদিক এ নিয়ে আলোচনা সমালোচনা চালিয়ে গেছেন জাতিসংঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে।
গত ২৩ মে জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ও র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। সেখানে বলা হচ্ছে- মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের এই মিশনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তবে দেশের সেনাপ্রধান এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা প্রতিবেদনটিকে উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং একপেশে বলে অভিযোগ করেছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী কীভাবে নিয়োজিত হয়, প্রক্রিয়াটা কী, কারা এটা করেন, সেটা সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে বলে মনে হয় না। যদি ধারণা থেকে থাকে, তাহলে যারা এটা বলেছেন, তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাংলাদেশকে হেয় করার জন্য বলছেন। যদি সেটা না হয়, তাহলে তারা এ প্রক্রিয়াটা জানেন না।
ডয়েচে ভেলের প্রতিবেদন প্রকাশের পরদিন বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সেক্রেটারি মুশফিকুল ফজল আনসারী নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত নিয়মিত ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিকের কাছে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন। সেই নিয়মিত ব্রিফিংয়ের এজেন্ডায় বাংলাদেশ নিয়ে কোন প্রসঙ্গ ছিল না। এমনকি সেখানে উপস্থিত অন্তত ১৫ জন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কেউই এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখায়নি, বরং ফজল আনসারির অপ্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা থামিয়ে প্রশ্ন সম্পর্কে জানতে চান স্টিফেন।
প্রশ্নের জবাবে মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সেসব ব্যক্তিকে মোতায়েন করে, যাঁরা সর্বোচ্চ দক্ষতা ও সততার নীতি বজায় রেখে কাজ করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তা রক্ষার অঙ্গীকার। শান্তিরক্ষী মোতায়েনের আগে তাঁদের জাতিসংঘের নির্ধারণ করে দেওয়া মানবাধিকার রেকর্ড যাচাই–বাছাই করে দেখা হয়।
স্টিফেন তার বক্তব্যে জাতিসংঘের দায়বদ্ধতার জায়গা তুলে ধরে বলেন, আমরা আবারও খুব সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো এবং তা রক্ষার অঙ্গীকারকে অন্তর্ভুক্ত করে দক্ষতা ও সততার সর্বোচ্চ যে মান নির্ধারণ করা হয়েছে, তা মেনে (জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে) কর্মী মোতায়েনের বিষয়ে জাতিসংঘ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংশ্লিষ্টতা যাচাই–বাছাইয়ের যে নীতি রয়েছে, তার ভিত্তিতে নিয়মনীতিও গড়ে তুলেছে জাতিসংঘ।
স্টিফেন ডুজারিক আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে আমাদের জানানো হয়েছে, শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কর্মকর্তারা অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে শান্তিরক্ষার কাজে নিয়োজিত আমাদের সহকর্মীরা যথাযথ পদক্ষেপ নেন। যাচাই–বাছাইয়ের নীতি এবং সেনা সরবরাহকারী দেশের সঙ্গে আলাপ–আলোচনার মাধ্যমে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অনেক ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন না–ও করা হতে পারে—এমনকি তাঁদের প্রত্যাহার করতে পারে জাতিসংঘ।
স্টিফেনের এই বক্তব্যের ফলে বুঝা যায় যে, এতবছর অভিযোগ আসলেও এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ পায়নি জাতিসংঘ। প্রমাণ ছাড়াই বারবার শুধু তীর ছোড়া হয় বাংলাদেশের বাহিনীর দিকে।
বাংলাদেশের সেনাপ্রধান এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের যখন আমরা ইউএন মিশনে শান্তিরক্ষী হিসেবে পাঠাই, এটা কিন্তু একটা খুব জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমাদের সিলেকশন প্রসিডিউর, ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে তাদের প্রস্তুত করা, লজিস্টিক্যাল সাপোর্টসহ সব ক্ষেত্রে আমরা পেশাদারত্বের সঙ্গে করে থাকি। এখানে এসব ব্যত্যয়ের সুযোগ নেই। সবাই বুঝতে পারছে যে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এ প্রতিবেদন করা হয়েছে। সেই উদ্দেশ্যটা কী? আমরা সবাই বুঝতে পারছি। আমরা আমাদের কাজটা সঠিকভাবে করতে চাই। যারা অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছে, তাদের আমরা সর্বান্তকরণে ভূল প্রমাণিত করতে চাই।’
জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তুলে প্রতিবেদন বানিয়ে আসছে ডয়েচে ভেলে। গত বছর জাতিসংঘের মিশন সংস্কার করা নিয়ে একটি প্রতিবেদন করে সংবাদ মাধ্যমটি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে এই প্রথম প্রতিবেদনটি করেছে। সংশ্লিষ্টদের ধারনা, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের মিশনে যুক্ত হয় বলে বাংলাদেশকে টার্গেট করা হতে পারে। কারণ একই অভিযোগের চারটি ভিডিও প্রতিবেদন করেছে সংবাদমাধ্যমটি, যা প্রথমটি প্রকাশের কয়েকদিন পর পর প্রকাশ করা হয়।
একই কাজটি ফজল আনসারি করেছেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে। ডয়েচে ভেলের সংবাদ নিয়ে যখন অন্য কোন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম এবং দেশে আলোচনা নেই তখন তিনি বিষয়টি আবার সামনে নিয়ে আসেন। মঙ্গলবার (২৮ মে) শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে ফজল আনসারির প্রশ্নে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, ‘আমরা এই রিপোর্টগুলোর বিষয়ে সচেতন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নয়নে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। শান্তিরক্ষী কর্মীদের মানবাধিকার রক্ষা করাটা অপরিহার্য। ইউএন ডিউ ডিলিজেন্স নীতি অনুসারে, এ বিষয়টি স্ব-প্রত্যায়িত করার জন্য সেনা এবং পুলিশ পাঠানো দেশগুলোর উপর জাতিসংঘ নির্ভর করে যে- তারা মানবাধিকার লঙ্ঘন বা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের সাথে জড়িত সেনা বা পুলিশদের সেখানে (মিশনে) পাঠাচ্ছে না।’
১৯৮৮ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধে মিলিটারি অবজারভারস গ্রুপে একদল কর্মকর্তার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়। এই উজ্জ্বল অংশগ্রহণের ৩৭ বছর হতে চলেছে। এরপর থেকে বাংলাদেশ সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে জাতিসংঘ মিশনে কাজ করে চলেছে। জাতিসংঘে ব্লু হেলমেটের প্রশংসা এখন বিশ্বব্যাপী। মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের বীরত্ব ও ত্যাগের ইতিহাসও লম্বা। ২০০৫ সালে কঙ্গোতে ৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ পর্যন্ত মোট ১৬৬ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনে নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা আফ্রিকার দেশে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রেখে চলেছেন। পেশাদার মনোভাব, অবদান ও আত্মত্যাগের ফলে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান সুসংহত করেছে বাংলাদেশ। গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য বিভিন্ন সময়ে স্বীকৃতিও মিলেছে জাতিসংঘের। যার ফলে ডয়েচে ভেলে প্রতিবেদন করার কয়েকদিন পরেও ১০৮ জন পুলিশ সদস্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে কঙ্গোর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
২০২২ সালে শান্তি রক্ষা মিশন থেকে র্যাবকে বাদ দিতে আহ্বান জানিয়েছিল ১২টি মানবাধিকার সংস্থা। সেসময় জাতিসংঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডোজারিক বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে জানালেও এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ তেমন কোন প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায়নি।
সেনা কর্মকর্তাদের মতে, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী বেশ সুনাম ও কৃতিত্বের সঙ্গে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে কাজ করে গেছে। ১৯৯৩-৯৪ সালে সবচেয়ে আলোচিত রুয়ান্ডা, সোমালিয়া ও বসনিয়া—এই তিনটি শান্তি মিশনে দক্ষতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আলোচনার কেন্দ্রমূলে আসে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষায় নারীদের অবদান ও ভূমিকার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে। শান্তি রক্ষায় নারীর ভূমিকা ও লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যেই মূলত এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই সর্বপ্রথম ২০১০ সালে জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে পুলিশের নারী দল পাঠায়। ১৯৯৫ সালে ইউরোপের একমাত্র শান্তি মিশন বসনিয়ায় ফ্রান্স তাদের সেনা প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশি সেনারা তাদের জায়গায় কাজ শুরু করেন। ৩৪টি দেশের সেনাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন বাংলাদেশের ব্যাটালিয়নকে শান্তি রক্ষার কাজে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছিল।