পলাশ আহসান
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দীন সাহেব বলেছেন, ভোট দেয়া যেমন মানুষের অধিকার না দেওয়ও তার অধিকার। কোন সন্দেহ নেই, ভোট দেয়া এবং না দেয়া মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। গণতন্ত্রের প্রশ্নে একথা ধ্রুব সত্য। এই প্রশ্নে ভোট কেন, কোন কাজ মানুষকে জোর করে করানো মানবাধিকার লঙ্ঘন। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। সুশাসনের জন্যে বিখ্যাত, সুইজারল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়ামের মত বড় গণতন্ত্রের দেশেও ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। কেন? তারা কী মানবাধিকার সচেতন নয়? নিশ্চয়ই সচেতন। তাহলে কেন বাধ্যতামূলক করা হলো? সেই প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের নাগরিক এবং রাষ্ট্র সম্পর্কিত কিছু তত্ব কপচাতে হবে।
যেমন আমরা বলতে পারি, আসলে নাগরিকের জন্যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে, রাষ্ট্রের জন্যে নাগরিক আসেনি। রাষ্ট্রে নাগরিক গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন হচ্ছে সেই নাগরিকের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি। নেতারা সারা বছর নাগরিকের ভালমন্দ দেখবেন অর্থাৎ শাসনভার আগলে রাখবেন। আর নাগরিক একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর কারো কারো হাতে সেই শাসনভার তুলে দেবেন। অর্থাৎ নির্বাচনে অংশ নেয়ার অর্থ হচ্ছে শাসন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া।
তবে হ্যাঁ, দায়িত্ব পালন যদি বাধ্যতামূলক না হয় তাবে তিনি তা এড়িয়ে যেতে পারেন। সমাজের সবাই একই রকম দায়িত্ব পরায়ণ হবেন এমন আশা করাও ভুল। যিনি দায়িত্ব পালন করবেন না, তাকে যে কেউ দায়িত্বহীন বলতে পারবেন। তিনি খুব শক্তকরে এই অভিসম্পাতের প্রতিবাদ করতে পারবেন না। আর যারা ভোট দিয়ে শাসন পরিচালনায় অংশ নেবেন তারা দায়িত্ববান হিসাবে প্রশংসিত হবেন। কারণ তারা সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করলেন। বলা যায় তিনি নাগরিক দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করলেন।
এখন যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন কেন ভোটের ওপর আমি এত জোর দিচ্ছি। কারণ প্রসঙ্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে হলে আমাদের, ভোট দেয়া এবং না দেয়ার সামাজিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে হবে। দুটো প্রভাবই খুবই অর্থবহ। দুই প্রভাব আমাদের সমাজে দুইভাবে দেখা যায়। ভোট দিলে প্রথমত শাসন প্রক্রিয়ায় ভোটারের অংশ নেয়া হয়। দ্বিতীয়ত একজন শাসক নির্বাচিত হন। নির্বাচন শুরু হলো এবং ভোটার ভোট দিলো। খুব সহজ প্রক্রিয়া মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলে কী কাজটি এত সরল? এত সরল হলে কি ভোটের প্রসঙ্গ এত গুরুত্বপূর্ণ হতো?
ভোট দেয়ার মূল রসায়ন হচ্ছে কাকে ভোট দেয়া হলো এবং কে নির্বাচিত হলো? শাসনভার চালানোর মত যোগ্য মানুষ খুঁজে বের করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে ভোট। এই প্রক্রিয়ায় ভুল হলে শাসনভার চলে যেতে পারে অযোগ্যদের হাতে। ভোটার ভোট দেবেন একবার কিন্তু অযোগ্য ব্যক্তির হাতে শাসিত হবেন দীর্ঘদিন। যেটা শোষণের পর্যয়ে চলে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । যিনি শোষণ করেন তিনি অপরাধী সন্দেহ নেই। কিন্তু যিনি ভুল মানুষকে ভোট দিয়ে শোষক নির্বাচন করলেন, তিনিও ভুল নির্বাচনের দায় এড়াতে পারেন না।
এবার আসি ভোট না দেয়ার প্রসঙ্গে। একটা ভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে কয়েকজন নেতা নির্বাচিত হতে চেয়েছেন। তাদের মধ্যে যোগ্য মানুষ যেমন আছেন অযোগ্য মানুষও আছেন। ভোটারদের কেউ ভোট দিলেন কেউ দিলেন না। তাতে কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া থামলো না। নির্বাচন শেষে দেখা গেলো যোগ্য মানুষটি থেকে গেলো নেতৃত্বের বাইরে। সেই ভুল নেতার হাতে যখন শাসন ভার গেলো তখন তিনি, যে ভোট দিয়েছে তারও শাসক আবার যে ভোট দেননি তারও শাসক। সুতরাং ভোট না দিয়েও শোষকের হাত থেকে কিন্তু মুক্তি মিললো না।
আমি আসলে বলার চেষ্টা করছিলাম ভোট আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ভোট না দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কতটা সতর্ক হওয়া উচিত। ধরা যাক একটি সমাজে নির্বাচন আসলো। কয়েকজন প্রার্থী ভোটারের সামনে দাঁড়ালো। ভোটাররা তাদের সম্পর্কে তথ্য নিলেন। প্রার্থীদের রাজনীতি, পরিবার, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান এবং সাম্প্রতিক কার্যক্রম বিবেচনায় আনলেন। ধরা যাক প্রার্থীদের একজন, অন্যজনের সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করছেন। গভীর পর্যবেক্ষণের কারণে ভোটাররা সেটা ধরে ফেললেন। একজন প্রার্থী ভোটকেন্দ্র না যাওয়ার জন্যে হুমক দিচ্ছেন। ভোটার সেটা মনে রাখলেন। একজন প্রার্থী সন্ত্রাস করেছেন । সেটাও মনে রাখলেন। এসব কিছু মাথায় এনে সীদ্ধান্ত নিলেন কাকে ভোট দেবেন। তার নির্বাচনের দিন চুপচাপ গিয়ে ভোটটা দিয়ে আসলেন। পাঠক ভাবুন সুশাসনের জন্যে এর চেয়ে ভাল কিছু কী আর হতে পারে?
ভোট দেয়ার কাজটি ভোটারের জন্যে কত গুরুত্বপূর্ণ, আমি জানি না এতক্ষণ ধরে সেটা বলতে পারলাম কী না? যিনি বুঝতে পারেননি তাকে বলবো আপনার চার পাশে বহু নির্বাচন হয়েছে এবং হচ্ছে। আপনি অতীতের কয়েকটি নির্বাচনের স্মৃতিচারণ করুন। দেখবেন ভুল এবং ঠিক নির্বাচনের উদাহরণ এবং এর ফলাফল আপনার সামনেই ভেসে উঠবে। আপিন কী ভুল করেছেন সেটাও যেমন জানবেন কী ঠিক করেছেন সেটাও বুঝবেন এবং এর থেকেই শিখবেন। কিন্তু ভাবুন কাজটি যদি আপনি না করতেন তাহলে স্মৃতি কোথায় পেতেন?
আসলে ঠিকঠাক নেতা নির্বাচনই একটি রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জটি শুধু আজকের নয় বা শুধু বাংলাদেশের নয়। সেই প্রাচীন গ্রিস থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্ত একই ইতিহাস। সেই ইতিহাসের পথেই হাঁটছে সভ্যতা। কেউ পিছ পা হয়নি। কিন্তু সব ইতিহাসেই দেখবেন কেউ না কেউ নানা অভিমানে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। কিন্তু তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি।
এই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময়ও ছোট একটি গ্রুপ নির্বাচনের বিরোধিতা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধকে তারা দুই কুকুরের লড়াই বলেছিল। তাতে নির্বাচনও আটকায়নি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও থামেনি, আমাদের স্বাধীনতাও আটকে থাকেনি। কিন্তু যারা যারা নির্বাচনে ‘না’ বলেছিল তারা কাগজে কলমে অনেক জ্ঞানীগুণী হলেও আজ তাদের কথা কেউ মনে রোখেনি। আসলে সভ্যতা সব সময় ‘হ্যাঁ’ এর পক্ষে। সভ্যতা এগিয়ে যায়, আর সেই পথে ‘হ্যাঁ’ বলাদের সবাই মনে রাখে, ‘না’ বলাদের কেউ মনে রাখে না। কারণ ‘না’ বলারা রাষ্ট্র সমাজ, এমন কী নিজেদের প্রতিও সুবিচার করেন না
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।