মাইকিংয়ে চলছে উর্দু কবিতার (শায়ের) ছন্দ। বলা হচ্ছে ‘মেরি মা বাহিনো আপকা পিয়ারা আপকা দুলারা’ ৭ জানুয়ারিকো আপনা কিমতি ভোট দেকার কামিয়াব কিজিয়ে’ সহ উর্দু ভাষায় আরও বলা হচ্ছে অনেক কিছু। আগামী ৭ জানয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নীলফামারীর-৪ আসনে (সৈয়দপুর ও কিশোরীগঞ্জ) সৈয়দপুর শহরে প্রতিবারের ন্যায় এবারও ভোটপ্রার্থনায় বাংলার পাশাপাশি উর্দু ভাষায় মাইকিং চলছে। মূলত সৈয়দপুর শহরে বসবাসরত প্রায় ৬০ হাজার অবাঙ্গালি ভোটারদের ভোট নিজের পক্ষে আনতে প্রার্থীরা প্রতি নির্বাচনে বাংলার পাশাপাশি উর্দুতেও প্রচারণা করে থাকেন।
প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলছে এই মাইকিং। এতে প্রার্থীদের পক্ষে ভোটপ্রার্থনাসহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিদিন বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত সৈয়দপুর পৌর শহরের বিভিন্ন এলাকায় অটোরিক্সায় করে মাইকিং করছেন আহমেদ হোসেন(৩৬)। তিনি দীর্ঘ ৮ বছর থেকে উর্দুতে মাইকিং করছেন। যেকোন বিষয়ে উর্দুতে ছড়া ও শায়ের এর সাথে মাইকিংয়ের জন্য ডাক পড়ে আহমেদের। তিনি জানান, এখন দম ফেলার ফুরসন নেই। বাংলার পাশাপাশি সাবলিল উর্দুতে মাইকিং করছেন তিনি শহরজুড়ে। তিনি আরও জানান, চটকদার মাইকিং ও শায়ের মানুষজন গুরুত্বসহকারে শোনেন এজন্য উর্দুতে মাইকিংয়ে আজও আগ্রহ সবার।
জেলা নির্বাচন কার্যালয়ের সূত্র মতে, নীলফামারী-৪ আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ২৬ হাজার ৩৪ জন। বর্তমানে কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় ভোটার সংখ্যা দুুই লাখ ১০ হাজার ৬৫১ জন এবং সৈয়দপুর উপজেলায় ভোটার সংখ্যা দুই লাখ ১৫ হাজার ৩৮৩ এর মধ্যে সৈয়দপুর পৌর এলাকায় অবাঙ্গালি ভোটাররাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এবিষয়ে নির্বাচনে প্রতিদন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের সাথে কথা বললে তারা দেশ রূপান্তরকে জানান, মূলত উর্দুভাষীদের কাছে ভোটপ্রার্থনা করতেই উর্দুতে মাইকিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে করে বয়স্ক উর্দুভাষীরা সহজে বুঝতে পারছেন কোন প্রার্থীর কি নাম, কোন প্রতীক (মার্কা)। যদিও অবাঙ্গালিদের নতুন প্রজন্ম থেকে সকল বয়সি বেশিরভাগ বাংলা বোঝেন, পড়েন। কিন্তু যারা একদম বৃদ্ধ তারা অনেকে বেশি বাংলা বোঝেন না বলে তাদের জন্য উর্দুতে মাইকিং বলে জানান তারা।
স্বতন্ত্র প্রার্থী মোখছেদুল মোমিনের পক্ষে উর্দু ভাষায় মাইকিংয়ে বলা হচ্ছে, ‘ইসবারকে চুনাবমে উমিদবার আওয়ামকা রাহনুমা মোখছেদুল মোমিনকে আপ আপনা কিমতি ওট দেকার কামিয়াব বানাইয়ে আউর শুকরিয়াকা মউকা দে’- যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী মোখছেদুল মোমিনকে আপনি আপনার মূল্যবান ভোট দিয়ে নির্বাচিত করুন এবং সেবা করার সুযোগ দিন।
অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক পক্ষে উর্দু ভাষায় মাইকিংয়ে বলা হচ্ছে, ‘জানে মানে হাস্তি, গারিবোকো দোস্ত সিদ্দিক ভাইকো কাইচি মার্কামে কিমতি ওট দেকার কামিয়াব বানাইয়ে।’ অর্থাৎ ‘সবার পরিচিত ব্যক্তিত্ব, গরিবের বন্ধু সিদ্দিক ভাইকে কাচি প্রতীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করুন।’
এদিকে বিজয়ের মাসে সৈয়দপুরে ভিন্ন ভাষাতে মাইকে প্রচারণার ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও সংবিধানে প্রত্যেকে তার মাতৃভাষায় কথা বলা কিংবা নিজ মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশের অনুমিত আছে তাই উর্দু ভাসায় মাইকিংয়ে অসুবিধা নেই বলছেন উর্দুভাষী নেতারা।
উর্দুভাষীদের নেতা উর্দুভাষী ক্যাম্প উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাজিদ ইকবাল মুঠোফোনে বলেন, আমাদের দেশের সংবিধান নিজ নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার দিয়েছে। আমাদের ক্যাম্পের নতুন প্রজন্ম এখন বাংলায় লেখা পড়ে দেশের সব নামিদামী ভার্সিটিতে পড়ছে, ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হচ্ছে। তবে বয়বৃদ্ধদের জন্য যদি উর্দুতে প্রচারণা হচ্ছে তাহলে অসুবিধা নেই।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সৈয়দপুর আওয়ামী লীগের একজন নেতা জানান, উর্দুভাষীরা এ দেশের ভোটার হয়েছেন। তাঁরা এখন নাগরিক। এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা পেয়েছে। কাজেই উর্দুভাষার নাগরিকদের কাছে তাঁদের মাতৃভাষায় ভোট প্রার্থনায় দোষের কী?
সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইসমাইল জানান, যদি দেশের সংবিধান ও নির্বাচন আচারণবিধি পরিপন্থি না হয়ে থাকে তাহলে যে কোন ভাষাতে প্রচারণা করতে পারে যে কেউ। যদি নির্বাচন পরিপন্থি হয় তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রকাশ্য যে, নীলফামারী-৪ আসনে রয়েছেন ৭জন প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী। এবারও জাতীয়পার্টিকে আসন ছাড় দিতে নৌকা প্রার্থী প্রত্যাহার হলেও খেলা মূলত স্বতন্ত্র বনাম স্বতন্ত্র হচ্ছে। ট্রাক প্রতীক বরাদ্দ নিয়ে মাঠে সক্রিয় আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মোখছেদুল মোমিন। অপরদিকে তাকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ দেওয়া অপর স্বতন্ত্র প্রার্থী কাচি প্রতীক নিয়ে জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিকও আছে মাঠে সক্রিয়।
অপর প্রতিদ্বন্দিরা হচ্ছেন লাঙ্গল মার্কা নিয়ে জাতীয়পার্টির বর্তমান সংসদ সদস্য আহসান আদেলুর রহমান, নোঙ্গর প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এম সাজেদুল করিম, সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে তৃনমুল বিএনপির ড. আব্দুল্লাহ আল নাসের, মশাল প্রতীক নিয়ে জাসদের আজিকুল হক, আম প্রতীক নিয়ে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আব্দুল হাই সরকার।
উল্লেখ্য যে, সৈয়দপুরে ভোটের সময় অবাঙ্গালিরা ভোটের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আসছে। এর মধ্যে অতীতে একজন অবাঙালি পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। পৌরসভা নির্বাচনেও অবাঙালি কাউন্সিলরা নির্বাচিত হয়ে আছেন আজও। এসব বিহারীরা জাতিগতভাবে পরিশ্রমী। তাই আয়-রোজগারের জন্য যেকোনো পেশা বেছে নিতে তারা কুণ্ঠাবোধ করে না। ক্যাম্পের বিহারীরা মানবেতর জীবন-যাপন করলেও বাইরে বসবাসকারীরা সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বিয়ে-শাদিসহ নানা সম্পর্ক গড়ে তুলছেন বিহারীরা। ছেলে-মেয়েদের শহরের নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করাচ্ছেন। তাদের ফলাফলও বাঙালিদের চেয়ে ভালো। কেউ কেউ উচ্চ পদস্থ চাকরিও করছেন।