আবু জাফর মিয়া

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি বাংলাদেশ। বছরের ছয় ঋতুতে ছয় রূপের বাংলাদেশ সৌন্দর্যে যেকোনো দেশের পর্যটনকে হার মানায়। এদেশের পাহাড়-পর্বত, অরণ্য, নদী-নালা, সমুদ্র সৈকত, সংস্কৃতি, জনগোষ্ঠী, ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব, সবকিছুই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের পর্যটককে আকৃষ্ট করতে পারে। এসব উপকরণ বিশ্ব পর্যটনে বাংলাদেশের জন্য আলাদা গুরুত্ব তৈরি করে। 

পরিবেশ ও প্রকৃতিগত ভারসাম্য বজায় রেখে এসব উপকরণ ব্যবহার করে টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করা  সম্ভব। এতে করে যেমন দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হবে, তেমনি  অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ার অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসেবে সারা বিশ্বে পর্যটনের গুরুত্ব অপরিসীম। বছরে প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার সংখ্যক পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে, যেখানে ১৯৫০ সালে পর্যটক সংখ্যা ছিলো মাত্র ২৫ মিলিয়ন। সারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের বাংলদেশও পিছিয়ে নেই।

পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) এবং সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে আড়াই কোটিরও বেশি পর্যটক রয়েছে, যেখানে ২০২০ সালে অভ্যন্তরীণ পর্যটক সংখ্যা ছিলো মাত্র ১ কোটি। মধ্যবিত্ত আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এ সংখ্যা আশীর্বাদস্বরূপ। কেননা, ধীরগতিতে হলেও পর্যটন খাতে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক সংকেত দিচ্ছে।

পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধিও বাড়ছে। পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন বাড়ে। তাই পর্যটন বৃদ্ধির সাথে সাথে পর্যটন কেন্দ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য আলাদা ফি থাকছে, সেখানে কাজ করার জন্য লোকবল যুক্ত হচ্ছে। এতেকরে কর্মহীন মানুষের কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে ১৫ লাখ মানুষ সরাসরি কাজ করছে। পরোক্ষভাবে রয়েছে ২৩ লাখেরও বেশি মানুষ। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করে দেওয়া এ খাতের দেশীয় আর্থিক মূল্য কমপক্ষে চার হাজার কোটি টাকা। পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা দেখে বর্তমান সরকারও নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে।

বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পর্যটন শিল্পের যথাযথ গুরুত্ব বুঝে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এ শিল্পের প্রসারে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, এ লক্ষ্য অর্জনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিভিন্ন কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১০ সালে জাতীয় পর্যটন উন্নয়ন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে টেকসই পর্যটন উন্নয়নের লক্ষ্যে ইকো ট্যুরিজম, কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম, দায়িত্বশীল পর্যটনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। পর্যটন শিল্পের কার্যকর উন্নয়ন দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার মাধ্যমে ২০৪১ সালে উন্নত- সমৃদ্ধ এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

দিন দিন পর্যটনের প্রসার হচ্ছে। নতুন নতুন স্থানে পর্যটনের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। পর্যটন মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে মোট ১ হাজার ৫১ টি ট্যুরিস্ট স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব স্থানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও যথেষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

পর্যটকদের পছন্দের বেড়ানোর তালিকায় এক নম্বরেই রয়েছে কক্সবাজার। কক্সবাজার জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ হচ্ছে- সমুদ্র সৈকত, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ছেড়াদ্বীপ, টেকনাফ সমুদ্র সৈকত, মহেশখালী দ্বীপ, রামু রাবার বাগান, রামু বৌদ্ধ বিহার, শাহপরীর দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, কুতুবদিয়া দ্বীপ, হিমছড়ি ঝর্ণা, ইনানী বিচ, ডুলাহাজরা সাফারি পার্ক, হিমছড়ি, আদিনাথ মন্দির, কুদুম গুহা ইত্যাদি। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত হচ্ছে পৃথিবীর দীর্ঘতম অখণ্ড সমুদ্র সৈকত যার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১২০ কিলোমিটার। কক্সবাজার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের এক লীলাভূমি।

কক্সবাজারের প্রাকৃতিক এ সৌন্দর্য আরো বহুগুণে বৃদ্ধি, পর্যটকদের এ অঞ্চলে যাতায়াত সহজ এবং পর্যটন স্পটসমূহে ভ্রমণ নিরাপদ করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নের্তৃত্বাধীন সরকার এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর বেশ বেশ কয়েকটির কাজ শেষ হয়েছে, কিছু চলমান রয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ, এয়ারপোর্ট নির্মাণ, ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগ স্থাপন, সড়ক পথে যাতায়াতের জন্য টেকসই রাস্তাঘাট নির্মাণ। ক্রুজশিপ বে ওয়ান পর্যটকদের চলাচল কষ্ট লাঘব করেছে। ৪০০ ফুট দৈর্ঘ্যের ৭ তলা বিশিষ্ট এ প্রমোদ তরি পর্যটকদের আরও বেশি করে আকৃষ্ট করে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে সরাসরি কক্সবাজারের সাথে যুক্ত করতে ২০২০ সালে চালু হয় বিলাসবহুল জাহাজ এমভি বে ওয়ান। এর মধ্য দিয়ে দেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা আরো অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়। সম্প্রতি সেন্টমার্টিন ভ্রমণে “সি-প্লেন” চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উদ্যোগটি বাস্তবায়িত হলে সারাবছরই সেন্টমার্টিনে থাকবে পর্যটক ভীড়। সরকারের এ ধরনের বাস্তবমুখী ও কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার ফলে এরইমধ্যে কক্সবাজারের পর্যটক আগমনের সংখ্যায় পূর্বের তুলনায় বিপ্লব ঘটেছে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, ১৬ ডিসেম্বর’ ২০২৩ তারিখ বিজয় দিবস উপলক্ষে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রায় ২ লক্ষাধিক পর্যটকের উপস্থিতি ছিল (সূত্রঃ ১৭ ডিসেম্বর’ ২০২৩, দৈনিক কালেরকন্ঠ)।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন শিল্প থেকে অবদান বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নয়নাভিরাম দৃশ্যের পাহাড়সমূহ। পর্যটনের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের এই পার্বত্য অঞ্চলের।  পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে পাহাড়-পর্বতসহ রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। বান্দরবানে রয়েছে মেঘলা, নীলাচল, নাফাখুম, দেবতাখুম, কেওক্রাডং, ডিম পাহাড়, স্বর্ণমন্দির, থানচি, চিম্বুক, বগালেক, শৈলপ্রপাত, তিন্দু, মারায়ন তং, নীলগিরিসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। এ সসব দর্শনীয় স্থানসমূহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। তাদেরকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে এসব জায়গায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন রিসোর্ট। ফলে এই অঞ্চলে থাকা-খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা হয়েছে পর্যটকদের জন্য। এ কারনে এসব অঞ্চলে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা আগেরে চেয়ে  কয়েকগুণ বেড়েছে। বান্দরবানের রুমা উপজেলার বম জনগোষ্ঠী সম্প্রতি দেশব্যাপি বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এসব জনগোষ্ঠীর সাথে থাকলে অনেক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হওয়া যায়। এভাবে কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজমও দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।

পর্যটন সম্ভাবনার দিক দিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিলেট অঞ্চল। সিলেটের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে-মালনীছড়া চা বাগান, জাফলং, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ, তামাবিল, লোভাছড়া চা-বাগান, লোভাছড়া পাথর কোয়ারি, রায়ের গাঁও হাওর, বিছানাকান্দি, পান্থুমাই জলপ্রপাত, লক্ষনছড়া, রাতারগুল ইত্যাদি। কর্মব্যস্ততার মাঝে একটু ছুটি পেলেই মানুষজন চলে যায় এসব জায়গায় ঘুরতে। এখন অনেক জায়গায় ছোট বড় রিসোর্টও তৈরি হচ্ছে শুধুমাত্র পর্যটকদের চাহিদার কথা ভেবে। পাহাড়ি  অঞ্চলগুলোতে চলাচলের সময় বিগত বছরগুলোতে রাস্তাঘাট বেহাল থাকায় অনেক ভোগান্তি পোহাতে হতো পর্যটকদের। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ টানা ৩ বারের মত সরকারে থাকায় রাস্তাঘাটের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ফলে পর্যটকদের আগের মত সেই ঝাক্কি-ঝামেলা এখন আর পোহাতে হয় না।

বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলগুলোও পর্যটন শিল্পের বড় উৎস হিসেবে কাজ করে। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ,নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এ সাত জেলায় প্রায় ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩ টি হাওর রয়েছে। এসব হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে কোটি কোটি মানুষ ভীড় করে।

এর পর আসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কথা। সাগরকন্যাখ্যাত ১৮ কিমি দৈর্ঘ্যের পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বালুময় সৈকতে বসে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগের এক বিরল সুযোগ রয়েছে। এ কারনে প্রতি বছর প্রচুর পরিমানে পর্যটক এখানে আসে। এক সময় এই কুয়াকাটা যেতে ৮ থেকে ১০ টি ফেরি পার হতে হতো।  পদ্মা সেতু নির্মাণসহ সব নদীর উপর ব্রিজ নির্মাণ করায় এখন সড়ক পথে কুয়াকাটায় যেতে একটি ফেরিও পার হতে হয় না। এছাড়া রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে সহজেই কুয়াকাটা যাওয়া যায়। ফলে এই অঞ্চলে আগের চেয়ে বহুগুণে পর্যটক বেড়েছে।

দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন পর্যটনশিল্পে অনবদ্য অবদান রাখছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবনে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করে। যেখান থেকে প্রায় ১ কোটি ৫২ লাখ টাকা আয় করে বাংলাদেশ। বর্তমানে এই পরিমাণ আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় পর্যটনশিল্প শুধু অর্থনৈতিক সফলতা বয়ে আনছে না, পাশাপাশি সামাজিক উন্নতি ও অন্যান্য দেশের মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরি করছে। ঠিকঠাক পদক্ষেপ নেয়ায় পর্যটন শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তবেই ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।