মাত্র এক রাতের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় যে পেঁয়াজের দাম ছিল ১২০ টাকা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাতেই সে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা দরে। আর শনিবার সকালে বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও ভারতের রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় বাজারে এই লঙ্কা কান্ড। ব্যবসায়ীদের হিসাবেই, দুই দিনে পেঁয়াজের বাজার থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে সিন্ডিকেট চক্র অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শনিবার সকালে রাজধানীতে পাইকারি পর্যায়ে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ কমে অর্ধেকের নিচে নেমে গেছে। তবে আমদানিকৃত পেঁয়াজের সরবরাহ আগের মতোই আছে। যেহেতু দেশি পেঁয়াজে ঘাটতি রয়েছে তাই উভয় পেঁয়াজের দাম প্রায় সমহারে বেড়েছে। মানভেদে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২১০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। যা খুচরায় বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ২২০ ও ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা দরে। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে ৭০ থেকে ৯০ টাকা পর্যন্ত। সহসাই এই দাম কমবে না বলেও মনে করছেন বিক্রেতারা।
ব্যবসায়ীদের হিসাবে, বর্তমানে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা বছরে প্রায় ৩৬ লাখ মেট্রিক টন। তবে সরকারি হিসাবে ২৫ লাখ টনের কিছু বেশি। সে হিসাবে একদিনে দেশের বাজারে গড়ে প্রায় ৯০ থেকে ৯৮ লাখ কেজি পেঁয়াজের লেনদেন হয়। দেখা গেছে, গত দুই রাতে বিভিন্ন ধাপে সিন্ডিকেট চক্র প্রতি কেজি পেঁয়াজে গড়ে ৮০ কোটি টাকা করে দুই দিনে মোট ১৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
হঠাৎ দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ এত কমার বিষয়ে জানতে চাইলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের রপ্তানি বন্ধে বেশিরভাগ স্টোরেজ ও মজুতকারী বাজারে পেঁয়াজ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজের ওপর চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এতেই উভয় পেঁয়াজের কেজিতে পাইকারিতে প্রথম দিনে অন্তত ৭০ টাকা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও ভারতের এই ঘোষণায় শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে আমদানিকারক থেকে শুরু করে খুচরা, যে যার জায়গা থেকে পেঁয়াজের মজুত বাড়িয়েছে অথবা বাড়তি দামে বিক্রি করেছে। মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের পেঁয়াজের পাইকার মো. সলিমুল্লাহ বলেন, শুক্রবার সকালে শ্যাম বাজার থেকে রাজধানীর পাইকাররা দেশি পেঁয়াজের বস্তা (৬০ কেজি) ৭,৪০০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৪,৫০০ টাকা হিসাবে কিনেছেন। শনিবার সকালে একই দেশি পেঁয়াজের বস্তা ১২,০৬০ টাকা ও ভারতীয় পেঁয়াজের বস্তা ১০ হাজার টাকার উপরে বিক্রি হয়েছে। এদিকে কল্যাণপুর নতুন বাজারে ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মণ্ডল জানান, ভারত রপ্তানি বন্ধের ঘোষণায় বাজারে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। শুক্রবার বিকাল ৪টা নাগাদ এই খবর বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। এর আধা ঘণ্টার মধ্যেই খুচরা ও পাইকারি সব জায়গা থেকেই ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ সরিয়ে ফেলেন। এর পর বিভিন্ন জায়গা থেকে দাম বৃদ্ধির খবর আসতে থাকে। তখন অনেকেই বেশি দামে বিক্রি শুরু করেন। অন্যদিকে সন্ধ্যার পর সাধারণ ক্রেতারাও বাজারে পেঁয়াজ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। ফলে রাত ৯টার মধ্যে প্রতি কেজি পেঁয়াজে ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়।
বিশ্বনাথ বলেন, শুক্রবার সারা দিন মাত্র ২৫ কেজির মতো পেঁয়াজ বিক্রি করলেও সন্ধ্যার পর প্রায় ৩ মণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। যেহেতু একদিন আগে এই পেঁয়াজ কেনা হয়েছে তাই প্রতি কেজি প্রায় ৫ গুণ বেশি মুনাফা করেছেন বেশিরভাগ খুচরা ব্যবসায়ী। এই বাজারের কেউ কেউ শুক্রবার রাতেই ১ লাখ টাকা বাড়তি মুনাফা করেছেন বলেও জানা গেছে।
একই অবস্থা পাইকারি পর্যায়ে, সংবাদ মাধ্যমে রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার ১ ঘণ্টার মধ্যেই সব পর্যায়ের সিন্ডিকেট চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। বাড়তি মুনাফার আসায় অনেক ব্যবসায়ী আড়ত বন্ধ করে দেন। এমনকি শনিবার সকালেও বন্ধ ছিল পেঁয়াজের অনেক আড়ত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক রাতেই পরিস্থিতি বদলে গেছে, ভারত ফের রপ্তানি শুরু করার ঘোষণা দিলেও বাজার স্বাভাবিক হতে অন্তত এক থেকে দু’সপ্তাহ সময় লাগবে।
এদিকে বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ আসতে শুরু করেছে, এখন মুড়িকাটা পেঁয়াজ পাওয়া গেলেও ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সরবরাহ বাড়বে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে এবং দেশি পেঁয়াজের মজুত আছে তাতে অন্তত দুই মাস বাজারে কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। ফলে বাজারে ভোক্তার পেঁয়াজের বাড়তি ব্যয়ে পুরোটা চলে যাবে সিন্ডিকেটে এবং মুনাফাভোগীদের হাতে। যদি এক সপ্তাহ এই দাম বজায় থাকে বা এর থেকে অর্ধেক কমে গেলেও অসাধু চক্র অন্তত ৩শ’ কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নেবে।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার এ বছর ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজের পাশাপাশি ডিম, চিনি ও আলুর দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল। যেখানে আমদানি পেঁয়াজের দাম সর্বোচ্চ ৪০ এবং দেশি ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাজারে গত ৪ মাস উভয় পেঁয়াজ ˜িগুণ দামে বিক্রি হয়ে আসছে। যা শনিবার বেড়ে নির্ধারিত দামের চারগুণ হয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি বা ডলার সংকটের কারণে বর্তমান বাজার ব্যবস্থাপনায় নীতিগত এবং পরিচালনাগত ঘাটতি বেশি ভোগাচ্ছে। ফলে কর হ্রাস ছাড়, আমদানি কিংবা সরবরাহ বাড়িয়ে বাজার স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। এছাড়াও নির্ধারিত দাম কার্যকর না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পেশাগত দুর্বলতা স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আমদানি পণ্যে বাজারে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একচ্ছত্র আধিপত্য গোটা ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে। তারা আইনের তোয়াক্কা না করেই নিজেরাই দাম বাড়িয়ে দিতে পারে এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। এছাড়াও নাগালের বাইরেই থাকছে বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট ও স্থানীয় সিন্ডিকেট চক্র।এই বিশ্লেষকের মতে, সরকারের উচিত দাম নির্ধারণ পদ্ধতি থেকে সরে এসে নতুন নীতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণ। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়াতে লোকবল বৃদ্ধিসহ সময়োপযোগী নীতি ও আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়া দরকার।