শেখ হাসিনা, প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ
এবং প্যাট্রিক ভারকুইজেন, সিইও, গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন
জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশ্বিক বিপর্যয় যা ধনীরা দরিদ্রদের উপর এবং ক্রমবর্ধমানভাবে নিজেদের উপর চাপিয়ে দেয়। দুবাইয়ে কপ-২৮ জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বানকারী বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে যে, তাদের ‘টপ-ডাউন’ পদ্ধতি কখনই কাজে আসবে না। বরং, আমাদের মতো ভুক্তভোগীদের লড়াইয়ের দায়িত্ব দিতে হবে এবং এই লড়াইয়ের জন্য অর্থায়ন করতে হবে।
বিশ্বনেতৃবৃন্দ তাদের বাকচাতুরির পেছনে যে সময় ব্যয় করবেন, পৃথিবীর জলবায়ুর নেতিবাচক পরিবর্তন তত সময় ধরে অপেক্ষা করবে না। এর মধ্যেই জনবসতির ওপর টাইফুন-বন্যা ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং ফসলহানি ও খরার মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ছে। জলবায়ু তহবিলের খুবই ক্ষুদ্র অংশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের সঙ্গে লড়াই করা মানুষের কাছে পৌঁছায়। তারা নিজেদের জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ-সহযোগিতা ছাড়াই টিকে রয়েছে, যা তাদেরকে আরও দুর্বল করে তুলছে। জলবায়ু বৈষম্যও আরও বেড়ে যাচ্ছে।
বৈশ্বিক পর্যায়ে জলবায়ু পদক্ষেপের কোনও মানে দাঁড়াবে না, যদি তা দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে সবার আগে আক্রান্ত হওয়া মানুষদেরকে রক্ষা করা না যায়। স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু-সহনশীল উদ্যোগের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত তহবিল দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে বণ্টন করার উপায়গুলো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন নতুন চিন্তাভাবনা এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। কপ ২৮ সম্মেলনে, বিশ্বকে অভিযোজনের জন্য অর্থায়ন দ্বিগুণ করতে হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডকে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হতে হবে, যাতে আমরা অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ এবং জলবায়ু প্রভাবের সঙ্গে আরও কার্যকরভাবে খাপ খাইয়ে নিতে স্থানীয় জনগণের চাহিদা মেটাতে দ্রুত এবং জরুরিভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে পারি। এটি জলবায়ুগত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্যও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
গ্লোবাল থেকে লোকালয়ে
২০২৫ সালের মধ্যে উন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিবর্তিত জলবায়ু পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রবাহ দ্বিগুণ করে ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর জন্য, গ্লাসগোতে কপ-২৬-এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুসারে, অর্থ সরবরাহকারীদের অবশ্যই ২০২২ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বার্ষিক অভিযোজন প্রবাহ গড়ে কমপক্ষে ১৬% বাড়াতে হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অভিযোজন অর্থ প্রবাহ ২০২১ সালে ১৫% কমে গিয়ে ২১.৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এটা স্পষ্টতই খুব কম। এটি ৬%এরও কম এবং সম্ভবত ২%এর মতো, যা স্থানীয় জনগণের চালানো জলবায়ু-সহনশীল প্রকল্পগুলোতে পৌঁছেছে। অর্থ প্রবাহ সঠিকভাবে ট্র্যাকিং এবং রিপোর্ট করার অভাবের কারণে হিসাব-নিকাশগুলো বদলে যায়। এই পরিস্থিতির উন্নয়ন দরকার। কারণ জলবায়ু নীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টিও উপর থেকে নিচে প্রবাহিত হয়।
কোন শহর, রাস্তা, জমি এবং বাড়িঘর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সেটি তারাই জানেন, যারা সেখানে বসবাস করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমাদের অবশ্যই তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে তাদের নিজস্ব প্রকল্পগুলো তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে উৎসাহ দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষমতায়ন করতে হবে।
এটা বলা সহজ, করা কঠিন। জলবায়ু সহনশীলতা জোরদার করার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পগুলো পরিচালনা করার জন্য প্রায়শই স্থানীয় জনগণের সময় এবং দক্ষতার অভাব হয়। প্রকল্প প্রস্তাবগুলো তৈরিতে তাদের সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তহবিল প্রাপ্যতার জন্য তাদের আইনি সংস্থা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো মৌলিক জিনিসগুলো প্রয়োজন।
স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু অভিযোজনে বাংলাদেশ সর্বদা নেতৃস্থানীয় এবং সম্প্রতি সরকার স্থানীয় কমিউনিটির কাছে জলবায়ু সহায়তা সরবরাহের বিভিন্ন উপায় অনুসন্ধান করছে। জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা অভিযোজনের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ পেতে সহায়তা করে, একই সঙ্গে এটি অভিযোজনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কমিউনিটি ও স্থানীয় সরকারকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি জলবায়ু ঝুঁকি তহবিল। যাতে গ্রিন ব্যাংকিং পরিষেবাগুলো বাড়ানো এবং বাস্তুসংস্থান পরিষেবাগুলোর জন্য দাতাগোষ্ঠীর খোঁজে থাকে।
ঢাকায় গ্লোবাল হাব অন লোকাল লেড অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে সমাধান বাড়াতে এবং বিশ্বের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের সাথে যথাযথ করণীয় অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে সহায়তা করছে। এই প্রচেষ্টাগুলো ইতোমধ্যে অবিশ্বাস্য উন্নতি অর্জন করছে।
চ্যালেঞ্জ থেকে সুযোগ
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মোংলায় মেয়র ও সেখানকার বাসিন্দারা তাদের জলবায়ু চ্যালেঞ্জের মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ চিহ্নিত করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করছেন। অন্যান্য প্রধান শহরগুলোর মতো মোংলায় এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে লড়াই করছে। এসব গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল। মোংলায় বসতি স্থাপন, জলবায়ুর মূল দুর্বলতা চিহ্নিতকরণ এবং স্থানীয়ভাবে পরিচালিত উদ্যোগের উন্নয়ন করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক এবং গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে কাজ করা যুক্তরাজ্য ও কানাডা সরকারের সহায়তায় মোংলার পিপলস অ্যাডাপটেশন প্ল্যান জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া অন্যান্য শহরগুলোর জন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, স্থানীয়ভাবে পরিচালিত অভিযোজনই এগিয়ে যাওয়ার উপায়। তবে আমাদের এই পদ্ধতিগুলো ব্যাপকভাবে বাড়ানো দরকার। এর জন্য, দাতাদের জন্য অযৌক্তিক ঝুঁকি তৈরি না করে আমাদের স্থানীয় কমিউনিটিকে অর্থায়নের উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি-র মতো আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বৃহৎ অর্থদাতাদের পোর্টফোলিওতে জনগণের অভিযোজন পরিকল্পনাকে ত্বরান্বিত করার জন্য শক্তিশালী মধ্যস্থতাকারী সংস্থাগুলো ট্রান্সমিশন বেল্ট হিসাবে কাজ করার জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
কপ-২৮ সম্মেলন কেবল তখনই সফল হবে, যদি এটি জলবায়ু সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য সত্যিকারের সুবিধা অর্জন করবে। এ বছরের জলবায়ু সম্মেলনে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং এটি স্থানীয়ভাবে পরিচালিত, উপযুক্ত এবং কার্যকর অভিযোজন হবে। আমরা যদি এটি অর্জন করতে পারি, তাহলে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের চরম অবিচারের প্রতিকারের দিক থেকে এটি একটি বড় পদক্ষেপ হবে।
নিউজউইক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের অনুবাদ