‘সেবা নিন, সুস্থ্য থাকুন, স্বচ্ছ দৃষ্টিতে সুন্দর পৃথিবী দেখুন।’ জনবল, শয্যা আর সরঞ্জাম সংকটের মধ্যদিয়ে প্রায় দেড় বছর পর চালু হলো নীলফামারী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চোখের ছানি অপারেশন। নেই চাহিদার তুলনায় ইনজেক্টবল স্যালাইনসহ পর্যাপ্ত ওষুধ। ১০ শয্যার চক্ষু বিভাগটি বর্তমানে আসন সংখ্যা কমিয়ে পাঁচ শয্যায় আনা হয়েছে। বাকী পাঁচটি শয্যা নবজাতকের ওয়াডে সংযুক্ত করা হয়।
ওই বিভাগে থাকার কথা দুইজন মেডিকেল অফিসার, একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট, একজন সহযোগি অধ্যাপক (বিভাগীয় প্রধান) ও পাঁচজন নার্স ও আয়া একজন। এরমধ্যে রয়েছে, মেডিকেল অফিসার একজন, সিনিয়র কনসালটেন্ট একজন, সহযোগি অধ্যাপক একজন। বর্তমানে পাঁচজন নার্স এর বিপরীতে রয়েছে তিনজন। এরমধ্যে একজন মাতৃকালিন ছুটিতে, আরেকজন নাইট করে, বাকী একজন দিয়ে চলছে চক্ষু ওয়াডটি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ওয়াডের একজন সিনিয়র ষ্ট্যাপ নার্স বলেন, ‘পাঁচজনের মধ্যে আমি নার্স আমিই ইনচার্স সব কাজ আমাকেই করতে হয়। একারনে রোগিদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।’
নীলফামারী মেডিকেল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘জেনারেল হাসপাতালে দীর্ঘ দেড় বছর চোখের ছানি অপারেশন বন্ধ থাকার পর গত সোমবার (১১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পাঁচজন রোগির অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে বিভাগটি চালু করা হয়েছে। এরপর ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে ফের পাঁচজনের অপারেশন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সম্পদ সীমিত, রয়েছে নানা রকম সীমাবদ্ধতা চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবল সংকট। সরঞ্জমের মধ্যে লেন্স সংকট, বায়োমেট্রিক মেশিন, চোখের পাওয়ার দেখার (মেশিন) যন্ত্রপাতি নেই। এভাবেই সপ্তাহে বুধবার আউটডোরে রোগি দেখা হয় এবং প্রতি সোমবার ওটি (অপারেশন) করা হয়। রোগিদের সেবার কথা চিন্তা করে ব্যক্তিগতভাবে (বায়োমেট্রিক মেশিন, চোখের পাওয়ার দেখার যন্ত্র) কিছু যন্ত্রপাতি সরবারহ করে অপারেশনসহ আউটডোরে রোগির সেবা দেয়া হচ্ছে।’
চক্ষু বিভাগের ভর্তিকৃত রোগি মমতাজ আলী (৫৬) জানান, ‘দিনাজপুরসহ অনেক জায়গায় চোখের চিকিৎসা করে কোন ফল পাইনি। গত ১১ সেপ্টেম্বর ডা. মিজানুর রহমানের পরামর্শে চোখের ছানি অপারেশন করে এখন ভাল আছি। আগামিতে আমার ‘মা’কে এই ডাক্তারের কাছে আনার চিন্তা করছি। এখানে অল্প খরচে হাতের কাছে ভাল সেবা পাওয়া যায়।’
একই ওয়াডের রাবেয়া বেগম (৪৮) জানান, দেড় বছর আগে আমার স্বামীর চোখের অপারেশন করে এখনও ভাল আছে। তাই আমি গত সোমবার দুপুরে হাসপাতলে ছানি অপারেশন করেছি, আমি এখন ভাল আছি। অল্প খরচে বাড়ীর পাশে চোখের চিকিৎসা করে ভালই লাগছে।
সরেজমিনে, চিকিৎসক ও জনবল সংকটের বিষয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা বলেন, দুপুরের পর হাসপাতালে কোনও রোগী ভর্তি হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ছাড়া ওয়ার্ডে কোনও চিকিৎসকের দেখা মেলে না। পরের দিন ডাক্তার এসে চিকিৎসা দেয়। এটাই হাসপাতালে নিয়মে পরিনত করেছে কতৃপক্ষ। কোনও পরীক্ষা দিলে তার রিপোর্ট দেখাতে হয় পরের দিন দুপুরে।
এদিকে,ওয়ার্ডের শয্যা সংকট, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শৌচাগার ও ছাড়পোকার যন্ত্রনা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। এদিকে,বছরের পর বছর ধরে বন্ধ আছে ১০ শয্যার কার্ডিওলজি বিভাগটি। নষ্ট হচ্ছে লাখ লাখ টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম।
হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন নীলফামারী সদরের পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার বিকালে প্রচন্ড পেটব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছি। ভর্তির সময় জরুরি বিভাগের চিকিৎসক দেখেছেন। এরপর রাত পেরিয়ে সকাল পর্যন্ত ওয়ার্ডে কোনও চিকিৎসকের দেখা পাইনি। ছাড়পোকার কামড়, চিকিৎসক সংকট ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অভিযোগ হাসপাতালের একই ওয়াডের রোগী ও স্বজনদের।’
হাসপাতালের প্রশাসনিক শাখার তথ্য অনুযায়ী, ১০০ শয্যা নীলফামারী আধুনিক সদর হাসপাতাল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ২৫০ শয্যা হাসপাতালে উন্নীত হয়। ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পুরো কার্যক্রম শুরু হয়। এছাড়াও ২০২১ সালে আগষ্ট মাসে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেন।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. জহিরুল করিম জানান, ‘প্রায় সাত বছর আগে ২৫০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত হলেও ১০০ শয্যার জনবল দিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। তিনি বলেন, চক্ষুবিভাগের যন্ত্রপাতিসহ জনবল এবং ওষুধের চাহিদা জানিয়ে বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত প্রতিবেদন দিলেও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বিশেষ করে ঔষুধ ও ‘স্যালাইন’ সংকটতো আছেই।’
২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মো. আবু আল হাজ্জাজ বলেন, ‘দীর্ঘ দেড় বছর পর সরঞ্জাম সংকটের মধ্যদিয়ে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের পাঁচ শয্যার চক্ষু ওয়াডে চোখের ছানি অপারেশনসহ আউটডোরে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। আমরা সমস্যা গুলো লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। এখনও কোনও সমাধান পাওয়া যায়নি। তবে এখন পর্যায় ক্রমে হাসপাতালে ডাক্তারা আসছে। নতুনভাবে ফের চোখের ছানি অপারেশন চালু হলো।
উল্লেখ্য, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, ২৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে মঞ্জুরীকৃত চিকিৎসকের পদ সংখ্যা ৫৮ জন। এর বিপরীতে কর্মরত আছে ৩৫ জন। বাকী ২৩টি পদ শুন্য রয়েছে। কিন্তু এই জনবলের অনুমোদন আজও মেলেনি।
নার্স ও দ্বিতীয় শ্রেণির অনুমোদিত ১৫১ পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৪৪ জন। বাকী সাতটি পদেই শুন্য। তৃতীয় শ্রেণির ৪০ পদের বিপরীতে কর্মরত ১৮জন এবং চতুর্থ শ্রেণির ২৪ পদের বিপরীতে কর্মরত ১৮ জন। বাকী ৬টি পদই শূন্য। মোট ২৭৩ পদের বিপরীতে ৫৮টি পদ শূন্য রয়েছে। গত ছয় বছরেও ২৫০ শয্যার জনবল কাঠামোর অনুমোদন মেলেনি। ফলে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।