নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার শিক্ষকদের ক্লাস গ্রহণে উদাসীনতা, পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত তদারকির অভাবে দিনদিন কমে যাচ্ছে প্রতিবছর ‘কোটি টাকা’ ব্যয়ে পরিচালিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা। ইতোমধ্যে অনেকটা কমেও গেছে। তবে এখানে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে গ্রামে-গঞ্জে অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন তথা কেজি স্কুল প্রতিষ্ঠানও দায়ী।
উপজেলায় অনুমোদন ছাড়া ব্যাঙয়ের ছাতার মতো গড়ে উঠছে এই কিন্ডারগার্টেন। দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারিভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
এছাড়া শিক্ষার উন্নয়নে কয়েক বছর আগেও বেশকিছু বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেছে সরকার। শুধু তাই নয়, বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বই বিতরণ করে উৎসব পালন করা হয়েছে।
সরকারিভাবে শিক্ষার্থীদের উপকরণ কেনা বাবদ দেওয়া হচ্ছে উপবৃত্তি। এছাড়াও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দেওয়া হয়েছে সুসজ্জিত একাডেমিক ভবন। বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা, ক্ষুদ্র মেরামত ও প্লে শ্রেণির কক্ষ সজ্জিতকরণ এবং শিক্ষা উপকরণ কেনার পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রয়েছে একেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পাশাপাশি পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষকও নিয়োগ রয়েছেন। এরপরও শিক্ষার্থী কমছে প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
জানা গেছে, মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের অভাবের কারণে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন না অভিভাবকরা। বেশি টাকা খরচ হলেও তারা সন্তানকে দিচ্ছেন কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষা। যদিও ‘অভিভাবকদের কাঙ্ক্ষিত শিক্ষার’ উদ্দেশ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কোটি টাকা খরচ করছে সরকার।
অভিভাবকরা জানিয়েছেন, সঠিক জবাবদিহিতা নেই সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এ কারণে পাঠদানে আগ্রহী নন শিক্ষকরা। একইসঙ্গে সরকারি চাকরি স্থায়ী মনোভাবের কারণে ক্লাসে অনিয়মিত উপস্থিতি থাকে তাদের। পাশাপাশি অনেকেই এসএসসি বা এইচএসসি পাস করেই ঢুকে পড়েছেন এ চাকরিতে। সেক্ষেত্রে দুর্বল মেধার একটা প্রশ্নও থেকে যায়। সবমিলে এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার গুণগত মান দিনদিন কমে যাচ্ছে।
তারা বলছেন, শিক্ষকদের পাঠদান নিয়মিত মনিটরিং না করায় তারা এ ব্যাপারে আন্তরিক না। চাকুরি বাঁচানোর একটা উপায় হিসেবে তারা পাঠদান করছেন। তাই বাধ্য হয়ে অর্থ ব্যয় করে হলেও সন্তানদের কেজি স্কুলে পাঠাচ্ছি। এছাড়া শুধু আমরাই নয়, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ খোদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও নিজেদের সন্তানকে কেজি স্কুলে পাঠাচ্ছেন। ফলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন ‘গরিবের সন্তানদের স্কুলে’ পরিণত হয়েছে।
এদিকে, প্রতিবছর ব্যাঙয়ের ছাতার মতো কেজি স্কুলের সংখ্যাও বাড়ছে এ উপজেলায়। এসব স্কুলের অনুমোদন না থাকলেও ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে নানা অফার দিয়ে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করে। বহুমুখী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে পোস্টার, লিফলেট, বিলবোর্ডসহ মাইকিং করে শিক্ষার্থী ভর্তি করে তারা। অবশ্য টাকা বেশি নিলেও শিক্ষা দেওয়ায় তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিকল্প বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এছাড়া এসব স্কুলে উপজেলা শিক্ষা অফিসকে বিভিন্ন কৌশলে ম্যানেজ করে সরবরাহও করা হচ্ছে সরকারি বই।
উপজেলার কিছু কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিজেদের বিদ্যালয়ের ফলাফল ভালো দেখানোর জন্য কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীদের নাম হাজিরা খাতায় তুলে রাখছে। এভাবে তাদের হয়ে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষাও দিচ্ছে কেজি স্কুলের শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকদের দাবি, এ সুযোগ নিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা কেজি স্কুলকে সরকারি বই দিয়ে দেয়।
আবু ও শফিকুল ইসলাম নামে দুই অভিভাবক গণমাধ্যম কর্মীকে বলেন, প্রাথমিকের সরকারি শিক্ষকরা ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেতন নিয়েও ঠিকমতো ক্লাস নিচ্ছেন না। অথচ যারা সরকারি চাকুরি না পেয়ে কেজি স্কুলে মাত্র তিন থেকে চার হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ করছেন, তাদের পাঠদানে সবাই ঝুঁকে পড়েছেন। এর কারণ সরকারি বিদ্যালয়ে নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না। এছাড়া গুণগত মান যাচাই-বাছাই না করে গণহারে বেসরকারি বিদ্যালয়কে সরকারি করায় প্রাথমিক শিক্ষার মান অনেক কমে যাচ্ছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন কিছু শিক্ষক রয়েছেন, যারা নিজেই ইংরেজি পড়তে বা লিখতে পারেন না। এমন শিক্ষক শিক্ষার্থীকে কী পড়াবেন?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার বলেন, মনিটরিং করে একজন শিক্ষককে বদলি করার সুপারিশ করা গেলেও তাকে দক্ষ করার সুযোগ নেই। এছাড়া সরকারি চাকরি একবার হয়ে গেলে তা হারানোর কোনো ভয় তাদের মধ্যে থাকে না। কেজি স্কুলে চাকরি হারানোর ভয় থাকায় শিক্ষকরা বেশ আন্তরিক থাকেন। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয়কে গণহারে সরকারি করায় অনেক শিক্ষকের গুণগত মান নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার মান ফেরাতে শিক্ষকদের দক্ষ করতে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও ফাঁকিবাজদের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান করা প্রয়োজন বলে করেছেন তিনি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ড.মাহমুদা বেগম বলেন কেজি স্কুলের ভিড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কিছুটা কমে গেছে ঠিকই। সরকারি শিক্ষকরা আন্তরিক না হলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে শিক্ষকদের আন্তরিকতার সঙ্গে পাঠদানের আহ্বান জানিয়েছেন।