বৃহস্পতিবার , ২০ মার্চ ২০২৫ | ২৬শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ
  3. অর্থনীতি
  4. আন্তর্জাতিক
  5. আবহাওয়া
  6. ই-পেপার
  7. কৃষি
  8. খেলাধুলা
  9. গল্প ও কবিতা
  10. জাতীয়
  11. জীবনযাপন
  12. ধর্ম
  13. প্রযুক্তি
  14. বাংলাদেশ
  15. বিনোদন

বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও আমাদের করণীয়

প্রতিবেদক
রংপুর প্রতিনিধি
মার্চ ২০, ২০২৫ ৭:৪২ অপরাহ্ণ

আজ ২১শে মার্চ, আন্তর্জাতিক বন দিবস। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। বন আমাদের বিশুদ্ধ বাতাস, খাদ্য, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সরবরাহের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ, ভূমিক্ষয় রোধ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, নগরায়ণ, বন উজাড়, অবৈধ দখল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শিল্পায়নের ফলে বনভূমির পরিমাণ দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। তাই বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিশ্বব্যাপী ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ২৮শে নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২১শে মার্চকে আন্তর্জাতিক বন দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। প্রতি বছর এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে বন সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী মানুষকে সচেতন করা হয়।

এবারের আন্তর্জাতিক বন দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘বন বনানী সংরক্ষণ, খাদ্যের জন্য প্রয়োজন’। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে বন সংরক্ষণে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। বন বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস যা মানবজাতির টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। শুধু খাদ্য নয়, বন আমাদের বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করে, কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ রাখে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। পাশাপাশি এটি ভূমিক্ষয় রোধ, নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, একটি দেশের মোট আয়তনের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান বনভূমির পরিমাণ প্রায় ১৫.৫৮ শতাংশ যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

বাংলাদেশের বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ হলো অবৈধ দখল, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, কৃষিজমির সম্প্রসারণ এবং অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন। তবে ইতোমধ্যে সরকার ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন বন সংরক্ষণে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে ৯ হাজার ৪৬৭ হেক্টর রক্ষিত বনভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। যা বন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ। তদুপরি বন সংরক্ষণে সামাজিক বনায়নের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে এবং প্রান্তিক ও পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনজসম্পদ তৈরি হচ্ছে। সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে বনভূমি বৃদ্ধি, পরিবেশ উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং দারিদ্র্য বিমোচনে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে।

বাংলাদেশ সরকার বন সংরক্ষণে বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। ১৯২৭ সালের বন আইনকে আরও কার্যকর করতে ১৯৯০, ২০০০ ও ২০০৪ সালে একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধিত নীতিমালার মাধ্যমে বন ও পরিবেশ রক্ষার জন্য নানা বিধান চালু করা হয়েছে। এসব আইনের আওতায় অবৈধ গাছকাটা ও বনভূমি দখলের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি এই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হলে তাকে সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তবে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধিও অত্যন্ত জরুরি যাতে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বন সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করে।

অপরদিকে সামাজিক বনায়ন গ্রামীণ জনপদে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি বনভূমি সুরক্ষার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের বিনিয়োগের সুযোগও সৃষ্টি করেছে। বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সৃজিত বাগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১০,৭৩১ জন উপকারভোগী সরকারি বাগানে ১,০৮৩ হেক্টর এবং রাস্তায় ১,৯৩২ কিলোমিটার জুড়ে বৃক্ষরোপণ করেছেন। একই সময়ে, ৬,৬১২ জন উপকারভোগীর সরকারি বন বাগানে ২,৫১১ হেক্টর এবং রাস্তার ৫,৪৩৭ কিলোমিটার জুড়ে বৃক্ষ কর্তন করা হয়েছে। যার বিক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৮৪ কোটি ৫ লাখ ৮৯ হাজার ৭৩২ টাকা। এই আয়ের একটি অংশ উপকারভোগীদের লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম বন সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দেশের পরিবেশ সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে অভয়ারণ্য গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি অভয়ারণ্য স্থাপন করেছে। যেখানে প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য একটি নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তোলা হয়েছে। বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন, ২০১২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। যা বন্যপ্রাণী হত্যা, পাচার ও অবৈধভাবে বন্যপ্রাণীর দেহাংশ সংগ্রহের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রেখেছে। তবে শুধুমাত্র আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, আমাদের সবাইকে বন্যপ্রাণী, বন ও পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সচেতন হতে হবে এবং বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে বন সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ‘স্ট্রেংদেনিং রিজিওনাল কো-অপারেশন ফর ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় জোরদার করা হয়েছে। সুন্দরবনের সংরক্ষিত এলাকা রক্ষায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে যার ফলে তথ্য বিনিময়, বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ এবং বাঘ সংরক্ষণের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনের লক্ষ্যে ‘কমিউনিটি বেজড এডাপটেশন টু ক্লাইমেট চেঞ্জ’ প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

বনভূমি শুধু বিশুদ্ধ বাতাস, পানি ও খাদ্যের উৎসই নয়, এটি বহু মানুষের জীবিকারও মাধ্যম। বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ বন নির্ভর জীবিকা নির্বাহ করে। তাই বন সংরক্ষণ শুধু পরিবেশগত নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। বন রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বন দিবসে আমাদের প্রত্যেকের শপথ নেওয়া উচিত, আমরা আমাদের পরিবেশ ও বনভূমির সুরক্ষায় সচেষ্ট থাকব। বন সংরক্ষণ কেবল সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং এটি আমাদের সকলের দায়িত্ব। আসুন, আমরা একসাথে কাজ করি এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের পরিবেশ ও ভবিষ্যতকে নিরাপদ রাখি। বন রক্ষা মানেই আমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা।

সর্বশেষ - নীলফামারী

আপনার জন্য নির্বাচিত