উত্তরের জেলা নীলফামারীর সিংহভাগ মানুষের জীবিকার পথ হলো কৃষি। এ জেলার মাটি উর্বর দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ হওয়ায় বিভিন্ন জাতের ফসলের আবাদ হয়ে থাকে। এরমধ্যে একটি অর্থকারী মসলা জাতীয় ফসল হলো আদা। লাভের আশায়, গ্রামের কৃষক হুমরি খেয়ে বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছে।
সদরের অতিরিক্ত কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বকুল ইসলাম বলেন, প্রাকৃতিক দূর্যোগ (বন্যা খড়া) ও নানা রোগ বালাইয়ে মাটিতে রোপনকৃত আদায় কৃষক সারা বছরেই লোকসান গুনছে। বিশেষ করে কন্দপচা (রাইজোম রট) রোগে আক্রান্ত হলে আদার কাঙ্কিত ফলন পাওয়া যায় না। একারণেই মাটিতে আদা চাষে কৃষক আগ্রহ হারাচ্ছে। অপরদিকে, বাণিজ্যিকভাবে বস্তায় আদা চাষে আগ্রহী হচ্ছে তারা। তিনি বলেন, এবার সদরে এক লাখ ৫ হাজার বস্তায় আদার চাষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার ছয় উপজেলায় ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৫ বস্তায় আদা চাষ হয়েছে। এরমধ্যে নীলফামারী সদরে ১ লাখ ৫ হাজার বস্তা, ডোমারে ৬৫ হাজার বস্তা, ডিমলা ৬০ হাজার ২২৫ বস্তা, কিশোরগঞ্জে ৫৮ হাজার ৪০০ বস্তা, জলঢাকায় ২৬ হাজার বস্তা ও সৈয়দপুর উপজেলায় ১৮ হাজার ১৫০ বস্তা।
মসলা এবং ওষুধ হিসেবে আদা ব্যবহার হওয়ায় এর দামও প্রচুর। ভালমানের আদা প্রকারভেদে বর্তমানে বাজারে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তাই পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভাবে বাড়তি লাভের আশায় বস্তায় আদা চাষ করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
নীলফামারী সদরের রামনগর ইউনিয়নের বাহালী পাড়া গ্রামের আদা চাষি শফি উদ্দিন জানান, ‘অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সাথি ফসল হিসেবে কৃষকদের বাণিজ্যিকভাবে বস্তায় আদা চাষে আগ্রহ বেড়েছে। তিনি বলেন, আমার বাঁশ ঝাড়ের সাথে ছায়া ঘেঁরা ২০ শতাংশ জমি বরাবরই পড়ে থাকতো। সেখানে পরীক্ষামুলকভাবে এক হাজার বস্তায় আদা চাষ করছি। বর্ষায় সহজে পানি নিস্কাশন করা যায়, এতে আদা পচে না। নেই কোন পরিচর্চার বাড়তি খরচ। সীমিত জায়গায় অধিক পরিমান আদা উৎপাদন করা যায়। ফলে অল্প খরচে লাভবান হওয়া যায়।’
জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার বাহাগিলী ইউনিয়নের কৃষক মাহবুল ইসলাম জানান, ‘বাড়ীর পাশে পরিত্যাক্ত জায়গায় ২০০ বস্তায় আদা চাষ করছি। কৃষি অফিসের পরামর্শে নিয়মিত আদা গাছ স্প্রে ও পরিচর্যা করছি। সাথে কলাও চাষ করেছি। এক বছরে আদা ঘরে তুলবো, কলা থেকে যাবে। বস্তায় আদা চাষে খরচ কম। বাজারে আদার চাহিদা ও বেশী দাম থাকায় সব খরচ বাদে কলাসহ আমার লাভ হবে প্রায় দুই লক্ষ টাকা।’
জেলার ডোমার উপজেলার ছোট রাউতা গ্রামের আদা চাষী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি বিভাগের পরামর্শে ১৫ শতাংশ জমিতে দুই হাজার বস্তায় আদা চাষ করেন। প্রতিটি বস্তায় কমপক্ষে এককেজি করে হলেও দুই হাজার কেজি আদা (৫০ মন) হবে। যার মূল্য দাঁড়ায় ৩০০ টাকা কেজি দরে ৬ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, ‘বীজ কেনা, সার প্রয়োগ, বস্তা ক্রয় ও পরিবহন মিলে আমার প্রতি বস্তায় খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এতে ওই ১৫ শতাংশে দুই হাজার বস্তায় খরচ হয় এক লাখ ২০ হাজার টাকা। খরচ বাদে এক বছরে লাভ হবে চার লাখ ৮০ হাজার টাকা।’
সদর উপজেলার পঞ্চপুকুর ইউনিয়নের দীঘলটারি গ্রামের আবু কালাম জানান, ‘মাটিতে আদা চাষ করেছিলাম, কিন্ত আষাঢ় ও শ্রাবন মাসের অতিরিক্ত বৃষ্টিতে সব আদা পচে গিয়েছে। পিলাই (বীজ) আদাটাও পাই নাই। বারবার লোকসান করে বস্তায় আদা চাষের সিন্ধ্যান্ত নেই। কৃষি অফিসের পরামর্শে বস্তায় আদা চাষ শুরু করলে এখন লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছি। আশা করি, আগের ক্ষতি পুশিয়ে লাভবান হতে পারবো। আমার এই আদা চাষ দেখে আশেপাশের চাষিরাও বস্তায় আদা চাষের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘জেলার ছয় উপজেলায় ৩ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৫ বস্তায় আদা চাষ হয়েছে। বস্তায় আদা চাষের জন্য আলাদা করে জমির দরকার হয় না। বসতবাড়ি, পুকুর পাড়, জমির আইল, পতিত জমি ও অন্য ফসলের সঙ্গে সাথি ফসল হিসেবে আদা চাষ করে পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি আয় করে লাভবান হওয়া যায়।’